টানা ১৩ মাস ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির পর দেশের রপ্তানি আয় কমেছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে পণ্য রপ্তানিতে ৩৯০ কোটি ডলার (৩৭ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা) আয় হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কম। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৪১৬ কোটি ৫৪ লাখ ৫ ডলার। অর্থাৎ, রপ্তানি আয় কমে গেছে ২৬ কোটি ডলারেরও বেশি। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান দুই বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় তারা পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে। তৈরি পোশাকের রপ্তানি নিয়ে উদ্যোক্তারা কয়েক মাস ধরে বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সেখানকার মানুষ নিত্যপণ্যের বাইরে কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছে। সে কারণে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান দু-তিন মাস ধরে নতুন ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিয়েছে। অনেক পণ্য প্রস্তুত হওয়ার পরেও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান জাহাজীকরণের অনুমতি দিতে দেরি করছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, সার্বিকভাবে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের রপ্তানি ইতিবাচক ধারাতেই আছে। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি রয়েছে। এই সময়ে ১ হাজার ২৪৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের প্রথম তিন মাসে রপ্তানি হয়েছিল ১ হাজার ১০২ কোটি ডলারের পণ্য। গত মাসে সার্বিক রপ্তানি কমেছে মূলত পোশাকের রপ্তানি কমে যাওয়ায়। গত মাসে ৩১৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ কম। গত মাসে ওভেন ও নিট উভয় ধরনের পোশাক রপ্তানিই কমেছে। তবে সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে পোশাক রপ্তানিতে ১৩ দশমিক ৪১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি রয়েছে।
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে কৃষিপণ্য, হিমায়িত খাদ্য, হস্তশিল্প, বাইসাইকেল, আসবাব রপ্তানি কমে গেছে। তৈরি পোশাকের পর সবচেয়ে বেশি ৩৫ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় হোম টেক্সটাইলের রপ্তানি ২৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি। তৃতীয় শীর্ষ রপ্তানি হয়েছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে ৩২ কোটি ৭৯ লাখ ডলারের। গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় এই খাতের রপ্তানি ২০ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। জানতে চাইলে বাংলাদেশের নিট পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সংবাদমাধ্যমকে, বিশ্বমন্দার আশঙ্কায় রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কমে গেছে অর্ডারের সংখ্যা। যেমন আগস্ট-সেপ্টম্বরে এরকম কমপক্ষে নিট ও ওভেন মিলে ৩০ শতাংশ অর্ডার স্থগিত হয়ে গেছে। এর মধ্যে নিট খাতের বেশি। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির সাবেক সভাপতি এবং বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ) সংবাদমাধ্যমকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান দুই বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় তারা পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। তাদের এখন খাদ্যের পেছনেই অনেক বেশি খরচ করতে হচ্ছে। সে কারণেই বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমছে।
বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থা বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা করছে। এ অবস্থায় আগামী দিন আমাদের রপ্তানি আয়ে সুখবর নেই বলেই মনে হচ্ছে। বিজিএমইএর পরিচালক মো. মহিউদ্দিন রুবেল সংবাদমাধ্যমকে বলেন, কোভিড-পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী খুচরা বাজার বিভিন্ন সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে কনটেইনারের অপ্রতুল এবং সাপ্লাই চেইনের সংকট, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং পরবর্তী সময়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে পূর্বাভাষ অনুযায়ী মন্দার আবির্ভাব, যার কারণে খুচরা বিক্রয়ে ধস নেমেছে। ক্রেতাদের পোশাকের চাহিদা হ্রাস পাঁচ্ছে। ক্রেতারা তাদের ইনভেন্টরি ও সাপ্লাই চেইনকে নিজেদের জন্য লাভজনক রাখতে সতর্কতামূলক পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছে। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ কেউ উৎপাদন এবং অর্ডার পর্যন্ত আটকে রেখেছে। সামগ্রিকভাবে শিল্পের জন্য কঠিনপরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
মন্তব্য