শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
 

জঙ্গি সম্পৃক্ততায় বাড়িছাড়া ৭ জন গ্রেপ্তার

কণ্ঠস্বর ডেস্ক, ঢাকা
প্রকাশ: ৬ অক্টোবর ২০২২

 ছবি: দৈনিক যুগের কণ্ঠস্বর

জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে কুমিল্লা ও দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া চার তরুণসহ সাতজনকে মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

র‌্যাবের দাবি, দেশের সংবিধান ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি ক্রোধ ও ক্ষোভ জাগিয়ে তুলে সমাজ থেকে বাইরে নিয়ে এসে তাদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নিতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়ে আগ্রহী করে তোলে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িতরা। এছাড়া মুসলমানদের উপর নির্যাতনসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান দেওয়া হতো তরুণদের। ধাপে ধাপে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণদের সেইফ হাউজে পটুয়াখালী ও ভোলার বিভিন্ন চর এলাকায় সশস্ত্র হামলা, বোমা তৈরি, শারীরিক কসরত ও জঙ্গিবাদবিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

ফাইল ফুটেজ

বৃহস্পতিবার দুপুরে কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেছেন র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়াউইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। গ্রেপ্তাররা হলেন- পটুয়াখালীর হোসাইন আহম্মদ (৩৩), মো. নেছার উদ্দিন ওরফে উমায়ের (৩৪) ও বণি আমিন (২৭)। কুমিল্লা থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া গ্রেপ্তার চার তরুণ হলেন- ইমতিয়াজ আহমেদ রিফাত (১৯), মো. হাসিবুল ইসলাম (২০), রোমান শিকদার (২৪) ও মো. সাবিত (১৯)। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে নব্য জঙ্গি সংগঠনের তিন ধরনের প্রচারপত্র, বিস্ফোরক তৈরির নির্দেশিকা সম্বলিত পুস্তিকা, নব্য জঙ্গি সংগঠনের কর্মপদ্ধতি (খসড়া মানহায), উগ্রবাদী বই ‘নেদায়ে তাওহীদের’ ৪ কপি ও জিহাদি উগ্রবাদ ভিডিও সম্বলিত একটি ট্যাব জব্দ করা হয় বলে দাবি র‌্যাবের। খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ২৩ আগস্ট কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে ৮ তরুণ নিখোঁজ হয়। এ ঘটনায় নিখোঁজ সংক্রান্তে গত ২৫ আগস্ট কুমিল্লার কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি হয়। ঘটনাটি গণমাধ্যমে বহুলভাবে আলোচিত হয় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী চাঞ্চল্যের তৈরি হয়।

র‌্যাব নিখোঁজের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের উদ্ধারে ও জড়িতদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। তদন্তকালে প্রাথমিকভাবে জানা যায়, জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা বাড়ি ত্যাগ করেছে। এরইমধ্যে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত ৬ সেপ্টেম্বর বাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতিকালে ৪ তরুণকে হেফাজতে নিয়ে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয় র‌্যাব। এর ধারাবাহিকতায় গত বুধবার রাতে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১১ এর অভিযানে মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ ৮ তরুণের মধ্যে শারতাজ ইসলাম নিলয় (২২) গত ১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কল্যাণপুরের নিজ বাড়িতে ফিরে আসে। র‌্যাব ফিরে আসা নিলয়কে তার পরিবারের হেফাজতে রেখে বাকি নিখোঁজ ৭ সদস্য ও জড়িত অন্যান্যের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, গত ২৩ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে নিলয়সহ নিখোঁজ ৫ তরুণ নিজ বাড়ি থেকে বের হয়ে কুমিল্লা টাউন হল এলাকায় যায়। পরবর্তী সময়ে সোহেলের নির্দেশনায় তারা দুই ভাগ হয়ে লাকসাম রেল ক্রসিংয়ের কাছে হাউজিং স্টেট এলাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। নিলয়, সামি ও নিহাল একত্রে যায় করে কিন্তু ভুলবশত তারা চাঁদপুর শহর এলাকায় চলে যায়। তারা ভুল বুঝতে পেরে রাতযাপনের উদ্দেশ্যে চাঁদপুরের একটি মসজিদে অবস্থান করলে কর্তব্যরত পুলিশ তাদের সন্দেহজনক আচরণের কারণে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরবর্তী সময়ে দায়িত্বরত পুলিশ তাদের পাশের একটি হোটেলে রেখে যায় এবং পরদিন বাসায় চলে যেতে নির্দেশ দেয়। তারা রাতের বেলা হোটেল থেকে কৌশলে পালিয়ে পূর্ব নির্ধারিত জায়গায় গমন করলে সোহেল ও অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি তাদের লাকসামের একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। ওই বাড়িতে আগে থেকেই অবশিষ্ট তিনজন অবস্থান করছিল। পরে নিলয়, নিহাল, সামি ও শিথিলকে কুমিল্লা শহরের একটি মাদ্রাসার মালিক নিয়ামত উল্লাহর কাছে পৌঁছে দেয় সোহেল। নিয়ামত উল্লাহর তত্ত্বাবধানে একদিন থাকার পর সোহেল ৪ জনকে নিয়ে ঢাকায় আসে এবং নিহাল, সামি ও শিথিলকে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির কাছে বুঝিয়ে দিয়ে নিলয়কে পটুয়াখালীর একটি লঞ্চের টিকিট কেটে পটুয়াখালীতে পাঠায়। পটুয়াখালীতে গ্রেপ্তার বনি আমিন নিলয়কে গ্রহণ করে স্থানীয় এক মাদ্রাসায় নিয়ে যায়। সেখানে গ্রেপ্তার হুসাইন ও নেছার ওরফে উমায়েরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। বণি আমিন নিলয়কে তিনদিন তার বাসায় রাখে। তার বাসায় অতিথি আসায় পরে নিলয়কে হুসাইনের মাদ্রাসায় রেখে আসে। নিলয় মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে ১ সেপ্টেম্বর বাড়ি ফিরে আসে। নিলয়ের দেওয়া তথ্যমতে, বণি আমিনকে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। বণি আমিনের তথ্যমতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক এলাকা থেকে নেছার উদ্দিন ওরফে উমায়েরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হুসাইন আহমদ, রিফাত, হাসিব, রোমান শিকদার ও সাবিতকে নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

র‌্যাব বলছে, গ্রেপ্তাররা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, হাসিব ও রিফাত একবছর আগে কুমিল্লার কোবা মসজিদের ইমাম হাবিবুল্লাহর কাছে সংগঠনের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে ধারণা পায়। পরবর্তী সময়ে হাবিবুল্লাহ তাদের উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করে ফাহিম ওরফে হাঞ্জালার কাছে নিয়ে যায়। ফাহিম তাদের কুমিল্লার বিভিন্ন মসজিদে নিয়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মুসলমানদের উপর নির্যাতনসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান প্রদান করতেন ও ভিডিও দেখাতেন। এভাবে তাদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নিতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়ে আগ্রহী করে তোলেন। গ্রেপ্তার রোমান স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য গত ৪০ দিন আগে নিরুদ্দেশ হন এবং গ্রেপ্তার সাবিত দুই মাস আগে পটুয়াখালী থেকে নিখোঁজ হন। সোহেল নামক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া তরুণদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতির জন্য প্রশিক্ষণ নিতে পটুয়াখালী ও ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করা হয়। নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণদের বিভিন্ন সেইফ হাউজে রেখে পটুয়াখালী এলাকার সিরাজ ওরফে রবি নামের ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে পটুয়াখালী ও ভোলার বিভিন্ন চর এলাকায় সশস্ত্র হামলা, বোমা তৈরি, শারীরিক কসরত ও জঙ্গিবাদবিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো। র‌্যাবের লিগ্যাল আ্যন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক আরও বলেন, গ্রেপ্তার হোসাইন আহম্মদ পটুয়াখালীর একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। তার ভাষ্যমতে, নিষিদ্ধ ঘোষিত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন থেকে কয়েকজন সদস্যকে একত্র করে ২০১৭ সালে এই নব্য জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হয়।

পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালে সংগঠনটি ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ (পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার) হিসেবে নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশের নিষিদ্ধ সংগঠন, বিশেষত জেএমবি, আনসার আল ইসলাম এবং হুজির বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু নেতাকর্মী একত্র হয়ে এই উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে। গ্রেপ্তার হোসাইন সংগঠনের জন্য সদস্য সংগ্রহ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়া তিনি সদস্যদের বিভিন্ন তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সদস্যদের সশস্ত্র হামলার বিষয়ে প্রস্তুত করে তুলতেন। তিনি ২০১৪-১৫ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে সিরাজ নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হন। এখন পর্যন্ত ১৫ থেকে ২০ জন সদস্যসংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে বলে জানায়। গ্রেপ্তার নেছার উদ্দিন ওরফে উমায়ের ভোলায় একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালের আগে উগ্রবাদী কার্যক্রমে যুক্ত হন। তিনি হিজরতকৃত সদস্যদের প্রশিক্ষক ও তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এ ছাড়া তিনি সদস্যদের বিভিন্ন তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সদস্যদের সশস্ত্র হামলার বিষয়ে প্রস্তুত করে তুলতেন। তিনি ৯ থেকে ১০ জন সদস্যের তত্ত্বাবধান ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গ্রেপ্তার বণি আমিন উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করে পটুয়াখালী এলাকায় কম্পিউটার সেলস আ্যন্ড সার্ভিসের ব্যবসা করেন। তিনি সদস্যদের আশ্রয় প্রদান ও তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত ছিল। ২০২০ সালে হোসাইনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এখন পর্যন্ত ২২ থেকে ২৫ জন সদস্যকে আশ্রয় প্রদান ও তত্ত্বাবধানে জড়িত ছিলেন। গ্রেপ্তার রিফাত কুমিল্লায় অর্থনীতি বিষয়ে স্মাতক প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত ছিলেন। গ্রেপ্তার হাসিব উচ্চমাধ্যমিকশ্রেণিতে অধ্যয়নরত এবং একটি অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারা হাবিবুল্লাহর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে দীক্ষিত থেকে গত ২৩ আগস্ট বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়। গ্রেপ্তার রোমান পূর প্রকৌশল বিষয়ে ডিপ্লোমা করে গোপালগঞ্জে ইলেকট্রিক্যাল ও স্যানিটারির কাজ করতেন। তিনি অনলাইনে বিভিন্ন ভিডিও দেখে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হন এবং স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে সংগঠন সম্পর্কে ধারণা পান। পরবর্তী সময়ে প্রায় এক মাস আগে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হন। গ্রেপ্তার সাবিত উত্তরা এলাকায় প্রায় এক মাস আগে একটি ছাপখানায় স্টোর কিপারের কাজ করতেন। তিনি একজন আত্মীয় ও অনলাইনে ভিডিও দেখার মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হয়। গত জুন মাসে ঢাকায় সিরাজের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর প্রায় দুই মাস আগে তিনি নিখোঁজ হন।

মন্তব্য

পঠিতসর্বশেষ

এলাকার খবর

Developed By: Dotsilicon