মঈন নাসের খাঁন (রাফি),
শিক্ষা,সাহিত্য, ক্রীড়া ও সংস্কৃতির নগরী কুমিল্লা। যুগ যুগ ধরে এ কথা প্রচার হয়ে আসছে। কিন্তু ধর্মীয় দিক দিয়েও যে কুমিল্লা দেশের ইতিহাসে স্খান করে পথিকৃৎ হয়ে আছেন তার একটি প্রমান হলো ৩৫২ বছর ধরে স্বমহিমায় টিকে থাকা একটি মসজিদ। নাম তার শাহ সুজা মসজিদ।
এ মসজিদের নামকরণ, প্রতিষ্ঠাতার নাম ও প্রতিষ্ঠার তারিখ নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও এ মসজিদ যে পাক ভারত উপমহাদেশের প্রাচীন মসজিদ গুলোর মধ্যে অন্যতম সে বিষয়ে কারো সন্দেহ নেই ।
প্রবহমান গোমতী নদীর কোল ঘেষে কুমিল্লা শহরের মোগলটুলীতে এ মসজিদ অবস্খিত। আয়তনের দিক দিয়ে এ মসজিদ খুব বেশী বড় না হলেও এর কৃষ্টি, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সার্বিক অবয়ব আভিজাত্যের প্রতীক বহন করে| এর বাহ্যিক কারুকাজ প্রমান করে তৎসময়ে এর প্রতিষ্ঠাতাদের স্রষ্টার প্রতি সুবিশাল আনুগত্য এবং রুচির পরিচায়ক।
ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের প্রতীক মোগলটুলী শাহ সুজা মসজিদের প্রতিষ্ঠার প্রকৃত সন তারিখ উল্লেখ না থাকলেও বিভিন্ন জনশ্রুতি রয়েছে ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দে এ মসজিদ নির্মিত হয়েছে বলে প্রধান ফটকে তা উল্লেখ আছে।
শাহ সুজা যখন বাংলার সুবেদার তখন এ মসজিদ নির্মিত হতে পারে। কিন্তু তিনি নিজে এ মসজিদ নির্মাণ করেছেন বলে মনে হয় না। কারণ, শাহ সুজা কোন দিন ত্রিপুরা রাজ্য বিজয়ে এসেছিলেন বলে কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই। গোবিন্দ মানিক্যের তথাকথিত বন্ধু শাহ সুজা স্মৃতি রক্ষার্থে এ মসজিদ নিমার্ণ করেছিলেন, এই জনপ্রবাদ ভিত্তিহীন বলে মনে হয়। কারণ, ক্ষুদ্র হলেও একটি স্বাধীন রাজ্যের নৃপতি ছিলেন গোবিন্দ মানিক্য।
তিনি বন্ধুর শেষ স্মৃতি চিহ্ন বিক্রি করে তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে একটি মসজিদ নির্মাণ করে দেবেন, তা আদৌ সম্ভব বলে মনে হয় না। খুব সম্ভব কুমিল্লা শহর অঞ্চলে অবস্খিত মোঘল ঘাঁটির মুসলমান অধিবাসীদের নামাজ পড়ার সুবিধার জন্য তৎকালীন কুমিল্লার মোঘল ফৌজদার এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন এবং সুবেদার শাহ সুজার নামে এটিকে নামাঙ্কিত করেছিলেন।
আজ থেকে সাড়ে তিনশ বছর পূর্বে নির্মিত এই মসজিদটি উত্তর দক্ষিণে লম্বা। মসজিদের চার কোনে ৪টি অষ্ট কোনাকার মিনার ছিল।এগুলি মসজিদের ছাদের অনেক উপরে উঠে গেছে। সামনের দেয়ালে ছিল ৩টি দরজা এবং ভেতরে পশ্চিম দেওয়ালে ছিল ৩টি মেহরাব। কেন্দন্সীয় প্রবেশ পথ ও মেহরাব অন্য দুটির চেয়ে অনেক বড়।কেন্দ্রীয় দরজাটির বাইরের দিকে কিছুটা প্রসারিত এবং দুপাশে আছে দুটি সরু গোলাকার মিনার। মসজিদের সম্মুখ ভাগে প্যানেল দ্বারা সুশোভিত ছিল এবং কার্নিশের উপরে ছিল ব্যাটলম্যান্ট, তার ওপরে ছিল একটি গম্বুজ। কেন্দ্রীয় গম্বুজটি পাশের দুটি গম্বুজ থেকে আকারে বড়।
সাম্প্রতিকালে মসজিদের দুই প্রান্তে ২২ ফুট করে দুটি কক্ষ এবং সম্মুখ ভাগে ২৪ ফুট প্রশস্ত একটি বারান্দা নির্মাণ করায় আদি রূপ নষ্ট হয়ে গেছে। সজিদের উত্তর-পূর্ব কোণে একটি সুউচ্চ মিনারও নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদের বর্তমানে কোন শিলালিপি নেই। এই মসজিদ সম্বন্ধে কৈলাসচন্দ সিংহ (রাজমালা) ( খেলাসচন্দ্র সিংহ, ৯৩-৯৪ পৃ:) বলেন, মহারাজ গোবিন্দ্র মানিক্য সুজার নিমচা তরবারী বিক্রয় করেছিলেন। গোমতী নদীর তীরে কুমিল্লা নগরীতে সুজা মসজিদ নামক একটি ইষ্টক নির্মিত বৃহৎ মসজিদ অদ্যাপি দৃষ্ট হয়ে থাকে।
এই মসজিদ সম্পর্কে দুই প্রকার প্রবাদ শ্রুত হওয়া যায়:প্রথমত: সুজা ত্রিপুরা জয় করে বিজয় বৃত্তান্ত চিরস্মরণীয় করার জন্য এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, মহারাজ গোবিন্দন্স মানিক্য সুজার নামে চিরস্মরণীয় করার জন্য নিমচা তরবারী ও হিরকাঙ্গুরীয়ের বিনিময়ে বহু অর্থ ব্যয় করে এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। দ্বিতীয় প্রবাদ অপেক্ষা প্রথমোক্ত প্রবাদ সত্য বলে ধারণা করা হয়। এই মসজিদের দ্বার দেশে এ কথাও প্রস্তর ফলক সংযুক্ত ছিল। জনৈক প্রাচীন মুসলমানের নিকট এরূপ শ্রুত হয়েছে যে, অর্ধশতাব্দি কিংবা ততোধিক কাল পূর্বে জনৈক ত্রিপুরা রাজ সরকারী দেওয়ান ওয়াক্ফ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার জন্য সেই প্রস্তর ফলকটি উঠিয়ে গোমতীর নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন।
কুমিল্লার অন্তগর্ত সুজানগর নামক পল্লী সেই মসজিদের ওয়াকফ বলে জানা যায়।শ্রুত যাই থাকুক না কেন কুমিল্লার গোমতী তীরের শাহ সুজা মসজিদটি পাক ভারত উপ মহাদেশের প্রাচীন সভ্যতার অপূর্ব নিদের্শণ। মুসলমানদের গরীবের হজ্জের দিন শুক্রবার এই মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য মুসল্লিদের উপচে পড়া ভীড় সব সময়েই লেগে থাকে।
মন্তব্য