রাজধানীসহ সারাদেশে মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গত কিছুদিন ধরে প্রতিদিন ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। এটা যে শুধু শহরেই তা নয়, গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। গত সোমবার স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য সচিব রবিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় ৮৫৭ জন রোগী ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তির তথ্য জানিয়েছেন। অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক। দেশের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি ও চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৩ হাজারের বেশি। চলতি বছর ইতিমধ্যে ডেঙ্গুজ্বরে অন্তত ৯৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। প্রতিদিন শত শত নতুন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে এলেও সেখানে স্থান সংকুলান করা সম্ভব হচ্ছে না। করোনাভাইরাস মহামারির পর নাজুক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় ডেঙ্গুর এই প্রাদুর্ভাব দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক েেত্র একটি বড় ধরণের শক-ওয়েভ সৃষ্টি করতে পারে। অনেক দেরিতে হলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প থেকে স্বাস্থ্য সচিব ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ে সামগ্রিক অবস্থা তুলে ধরার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মিলিত প্রয়াস ও জনসচেতনা সৃষ্টির তাগিদ ব্যক্ত করেছেন। ময়লা-নর্দমা ও বাসাবাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানিতে জন্ম নেয়া এডিস মশা ডেঙ্গু রোগের মূল বাহক। এডিস মশা প্রতিরোধে সম্মিলিত উদ্যোগ ও জনসচেতনতা সৃষ্টির মধ্য দিয়েই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা করা সম্ভব।
ডেঙ্গু আক্রান্তের হার ইতোমধ্যে রেকর্ড ছাড়িয়েছে। সোমবার এক দিনে সর্বোচ্চ ৮৫৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর আগের দিন ভর্তির সংখ্যা ছিল ৮৫৫। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ভয়াবহ এ জ্বরে প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছেন কয়েক হাজার মানুষ; যাদের বৃহত্তর অংশ বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে সোমবার পর্যন্ত সারা দেশে হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪-এ। সোমবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৮৫৭ জনের মধ্যে ৫২৩ জন ঢাকা ও ৩৩৪ জন অন্যান্য জেলার বাসিন্দা। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৬ হাজার ৩৮ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ২২ হাজার ৯৩৮ জন। সোমবার ডেঙ্গুতে মারা গেছেন দুজন। এ বছর ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৯৬ জন। প্রায় প্রতিদিনই রেকর্ড ছাড়াচ্ছে ডেঙ্গু। চাপ বাড়ছে হাসপাতালগুলোয়। বিশেষ করে রাজধানীর সরকারি কোনো হাসপাতালেই ডেঙ্গু রোগীর জন্য বরাদ্দ শয্যা ফাঁকা নেই। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব বলেছেন, তারা চান না ২০১৯ সালের মতো গুরুতর পরিস্থিতি তৈরি হোক। এজন্য হাসপাতালগুলোয় আলাদা ডেঙ্গু ইউনিট চালু করা হবে। পর্যাপ্ত ফুইড সরবরাহের উদ্যোগ ও প্রয়োজনে প্রতিটি ওয়ার্ডে মশারি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। রোগী যদি মশারি না নিয়ে আসেন তাহলে হাসপাতাল থেকেই ব্যবস্থা করতে হবে।
এদিকে রাজধানীতে ডেঙ্গুর আগ্রাসন যখন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, তখন মশার উৎপাত বৃদ্ধি পেয়েছে নগরজুড়ে। যেসব এলাকায় গত কয়েক বছর মশার উপদ্রব ছিল নিয়ন্ত্রিত, সেসব এলাকায় মশা হানা দিতে শুরু করেছে আগের যে-কোনো সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ আগ্রাসী হয়ে। ডেঙ্গুর আগ্রাসন থামাতে মশা নিধন যেমন জোরদার করতে হবে তেমন এডিস মশার প্রজনন রোধে নিতে হবে কার্যকর ব্যবস্থা। এজন্য জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। দুই সিটি করপোরেশনের মশা নিধন কর্মকাণ্ড ঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না সে বিষয়ে নজরদারি জোরদার করাও জরুরি।
সাধারণত বর্ষার শেষদিকে (জুলাই থেকে অক্টোবর) এডিস মশার বংশ বিস্তারের সাথে সাথে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ বাড়ার কথা বলা হলেও বছরের শুরু থেকেই দেশে ডেঙ্গুর প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। এ নিয়ে গণমাধ্যমে উদ্বেগ ও সতর্কতামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলেও মাঠ পর্যায়ে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। বিশেষত ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের প্রত্যাশিত তৎপরতা পাওয়া যায়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সুত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের শুরু থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে রিপোর্টেড ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ২৬ হাজার ৩৮ জন। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ঢাকা শহর ও আশপাশের রোগী। ঢাকায় ডেঙ্গুরোগীর এই সংখ্যাধিক্যের মূল কারণ হচ্ছে, শহরের স্যুয়ারেজ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বেহাল অবস্থা, নাগরিকদের অসচেতনতা এবং মশা নিধনে সিটি কর্পোরেশনের ব্যর্থতা। এহেন বাস্তবতায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ও মৃত্যু ঠেকাতে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনসহ দেশের প্রতিটি সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা-উপজেলাসহ স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে পরিবেশগত নিরাপত্তা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং নাগরিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি স্কুল-কলেজ, মাদরাসাসহ সব সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনকেও স্থানীয় পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়ে এডিস মশার বিস্তার রোধ করতে হবে। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখা, কোথাও বদ্ধস্থানে পানি জমতে না দেয়া, ঘরে মশা প্রবেশ করতে না দেয়া এবং ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহারের মাধ্যমে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমিয়ে আনা সম্ভব। ইসলাম ধর্মে পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। এ বিষয়টি আমলে নিয়ে প্রত্যেক নাগরিকের সচেতন হওয়া উচিৎ। করোনাকালীন বাস্তবতায় পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যসচেতনতার বিষয়টি সারাবিশ্বে অন্যতম উপজীব্য বিষয়ে পরিনত হয়েছে। ডেঙ্গুর বাস্তবতাও আমাদের নাগরিক জীবনে পরিচ্ছন্নতা ও নাগরিক সচেতনতার গুরুত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছে।
করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ল্য অর্জিত হওয়ার আগেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় আমরা একটি সংকটকাল পার করছি। অর্থনৈতিক সংকটের বাস্তবতার মধ্যেই আগামী বছর দুর্ভিরে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ সময়ে দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় নতুন অভিঘাত হয়ে দেখা দিয়েছে। বলার অপো রাখে না, পরিবারের উপার্জনম ব্যক্তি অসুস্থ হলে বা রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে সেই পরিবারের দুর্দশার অন্ত থাকে না। পুরো পরিবারটি যেমন নিঃস্ব হয়ে যায়, তেমনি তা রাষ্ট্রের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এমনিতেই করোনা সামাল দিতে গিয়ে রাষ্ট্রের লাখ কোটি টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। এর মধ্যে নতুন করে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নতুন শঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার মধ্যে আরেকটি রোগ বিস্তার লাভ করলে তা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এর চিকিৎসা ব্যয়সহ নানা দুর্ভোগ রাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এ প্রেেিত, ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ সারাদেশের সিটি করপোরেশন, পৌরসভাগুলোকে ডেঙ্গু প্রতিরোধক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। অস্বীকার করার উপায় নেই, নাগরিক সচেতনতার অভাব, সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিচ্ছন্নতা, মশক নিধনসহ প্রশাসনের অসচেতনতা ও গাফিলতি রয়েছে।
গত কিছুদিন ধরে প্রায় প্রতিদিনই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হালকা বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বৃষ্টির পর বাড়ির চারপাশের পরিত্যক্ত স্থানে, পড়ে থাকা ভাঙ্গা পাত্র, ডাবের খোসা ও ড্রেনের বদ্ধ পানিতে যেন এডিস মশার লার্ভা জন্মাতে না পারে সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। ছাদ বাগানের টবগুলোতে নজরদারি বাড়াতে হবে। বিশেষত: সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, স্যুয়ারেজলাইন ও পরিত্যক্ত স্থানের পরিচ্ছন্নতা ও মশকবিরোধী অভিযান জোরদার করতে হবে। সেই সাথে প্রতিদিন শত শত ডেঙ্গুরোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে দেশের সব সরকারি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড সংরণ, দ্রুত রোগ নির্নয় এবং জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মনুষ্য দুর্যোগ এ দুটি ভিন্ন ধরণের। ডেঙ্গু থাবা এটি মনুষ্য দুর্যোগ বললে ভুল হবে না। আমাদের যেমন সচেতন হতে হবে, তেমনি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও জনসচেতনতায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলা করতে হবে।
মন্তব্য