ছোট ছোট ঢেউ থামছে পাড়ে এসে। হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে মৃদুমন্দ বাতাস। উত্তালতা নেই। নেই পানির গর্জন। আছে বিশালতা। সমুদ্রের মতো দিগন্তছোঁয়া না হলেও সেই বিশালতা স্থান-পাত্রভেদে সাগরের মতোই। তাই দিঘিটির নাম ধর্মসাগর যথার্থ বলা যায়। কুমিল্লা শহরের প্রাণ এই প্রাচীন দিঘি। ফুসফুসও বলে কেউ কেউ। শহরের মাঝে এত বড় জলাশয় থাকা মানে তো সাগরের সমানই!
সকাল কিংবা বিকেল- এর স্বচ্ছ পানি ও আশপাশের শান্ত পরিবেশ মন ভরিয়ে দেয়। দূর করে ক্লান্তি। মনে হবে আরেকটু বসে থাকি প্রাচীন এ জলাধারের পাশে। উপভোগ করি নৈসর্গিক দৃশ্য। বেলা ১১টার পরে গিয়ে দেখা গেলো দিঘির পাড়জুড়ে দর্শনার্থীদের ভিড়। তবে স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীই বেশি।
দিঘিতে ঢুকতে পারবেন চারটি পয়েন্ট দিয়ে। ঝাউতলা সড়ক, নজরুল একাডেমি সড়ক, ডিসি অফিস ও পুলিশ সুপার কার্যালয়ের পাশ দিয়ে।
দিঘির উত্তরপাড় এলাকায় রয়েছে পাঁচ একরের ‘নগর পার্ক’। উত্তর-পূর্বকোণে রানি কুটির, একটি শিশু পার্ক ও কুমিল্লা নজরুল ইনস্টিটিউট’। পূর্বে কুমিল্লা স্টেডিয়াম ও কুমিল্লা জিলা স্কুল, উত্তরাংশে সিটি করপোরেশনের উদ্যান ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় অবস্থিত। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে দিঘির পশ্চিম পাড়ে বিভিন্ন জাতের ফুল ও বাহারি গাছ লাগিয়ে দর্শনার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়নের তথ্যমতে, ত্রিপুরা রাজ্যের অধিপতি মহারাজা ধর্মমাণিক্য ১৪৫৮ সালে এই দিঘিটি খনন করেন। তিনি সুদীর্ঘ ৩২ বছর রাজত্ব করেন (১৪৩১-৬২ খ্রিস্টাব্দ)। কুমিল্লা শহর ও তার আশপাশের অঞ্চল ছিল তার রাজত্বের অধীন। জনগণের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য মহারাজা ধর্মমাণিক্য দিঘিটি খনন করেন। তার নামানুসারেই দিঘিটির নামকরণ করা হয় ধর্মসাগর।
নগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ধর্মসাগরের আয়তন ২৩.১৮ একর। ১৯৬৪ সালে দিঘিটির পশ্চিম ও উত্তর পাড়টি তদানীন্তন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সৈয়দ হাসান আহমদের উদ্যোগে পাকা করা হয়। দিঘিটি বর্তমানে মৎস্য বিভাগের অধীন। তবে দিঘির পশ্চিম পাড় ও সংলগ্ন পাঁচ একরের উদ্যানটি কুমিল্লা পৌরসভার। সবশেষ ২০১৫ সালে এটি সংস্কার করা হয়।
দিঘির চারপাশের সারি সারি সবুজ বৃক্ষ যেন দর্শনার্থীদের অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। মাঝেমধ্যেই কানে ভেসে আসবে পাখ-পাখালির কলকাকলী। রয়েছে সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চ। সেখানে বসে প্রিয়জনের সঙ্গে মেতে উঠতে পারেন খোশগল্পে। আর মাঝেমধ্যে দিঘির জলে ভিজিয়ে নিতে পারেন পা। সবমিলিয়ে সময় কাটানোর এক অপরূপ স্থান ধর্মসাগর।
শুধু বিকেল নয়, দর্শনার্থী-পর্যটক আর বিনোদনপ্রিয়দের পদচারণায় সব সময়ই জমজমাট থাকে এই দিঘির পাড়। কেউ ইচ্ছে করলে টিকিট কেটে প্যাডেল বোট নিয়ে দিঘিতে ঘুরতে পারেন, উপভোগ করতে পারেন নির্মল বাতাস। সে ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে।
ধর্মসাগরের পাড়ে সাঁটানো একটি সাইনবোর্ড থেকে জানা যায়, দিঘির এই জায়গাটিতে একসময় ছিল বিশাল আমবাগান। জনগণের পানি সংকট লাঘবে সেই আমবাগান কেটে এখানে এই দিঘিটি খনন করেন মহারাজা ধর্মমাণিক্য। তাই কখনো সমতটের রাজধানী খ্যাত কুমিল্লায় গেলে ঘুরে আসতে পারেন অপরূপ সৌন্দর্যের ধর্মসাগর। শান্ত দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে নিতে পারেন নির্মল বাতাস। দিঘির পাড়ে রয়েছে কিছু স্থায়ী ও কিছু ভ্রাম্যমাণ দোকান। তাই আড্ডার সঙ্গে খানাপিনায় সমস্যা নেই। দিঘিতে ঢোকার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। তাই চাইলে মর্নিং ওয়াক, ইভনিং ওয়ার্কও সারা যায় সহজে। আরেকটি বিষয়, দিঘিতে রয়েছে বিশাল আকৃতির সব মাছ। প্রতিবছর কয়েকবার এখানে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা হয়। টিকিট কেটে ধরতে হয় মাছ। এজন্য এক পাশে পাড়জুড়ে করা রয়েছে মাচা। মৎস্যপ্রেমীরা খোঁজ রাখতে পারেন বিশাল এ দিঘিতে মাছ ধরার সুযোগ।
মঈন নাসের খাঁন (রাফি)
কুমিল্লা জেলা প্রতিনিধি
মন্তব্য