মোঃ মিনহাজ আলম, ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধিঃ সারি সারি গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে টসটসে হলুদ কমলা। এ যেন সবুজের মাঝে হলুদের সমাহার । এ মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে প্রতিনিয়ত ভিড় করছেন হাজার দর্শনার্থীরা। সেখানে সকালে দেকছেন ছবি তুলছেন, পাশাপাশি সুস্বাদু কমলা খাওয়ার জন্য কিনছেন অনেকেই ।
১০ বছর আগে ২ নম্বর কোষারাণীগঞ্জ ইউনিয়নের মালঞ্চা গ্রামে ৩ বিঘা জমির ওপরে ভারতীয় দার্জিলিং জাতের কমলার বাগান করেন আবু জাহিদ মো. ইবনুল ইকরাম জুয়েল। বাগানটিতে রয়েছে আড়াইশ গাছ। অষ্টমবারের মতো এবারও চলতি মৌসুমে গত ১ ডিসেম্বর শুরু করেছে গাছ থেকে কমলা সংগ্রহ করা। ১০ বছর আগে হর্টিকালচার থেকে হাতে গোনা কয়েকটি চারা কিনে জমিতে রোপণ করেন। দুই বছরের মাথায় আশানুরূপ ফল পাওয়ায় বাগানের পরিধি বাড়ান। এখন তার বাগানে প্রায় ৩শ কমলাগাছ রয়েছে। বাগানের নাম দিয়েছেন অরেঞ্জ ভ্যালী। বাগানটি দেখতে প্রতিদিনি দূর দূরান্ত থেকে আসছেন প্রায় হাজারো দর্শনার্থীরা।
দেখার পাশাপাশি বাগান থেকে কমলাও কিনছেন তারা। প্রতি কেজি কমলা বিক্রি হচ্ছে ২০০-২৫০ টাকা করে। এভাবে প্রতিদিন বাগান থেকে ১৫০-২০০ কেজি কমলা বিক্রি হয়।
দার্জিলিং জাতের এসব কমলা স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে পাঠানো হচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। প্রতি বছর বাগানের পরিধি বাড়ায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে অনেকের। মূলত নভেম্বর থেকে উৎপাদিত কমলা বিক্রি করা হচ্ছে।
প্রতিটি গাছে ৮০০-৯০০ কমলা ধরেছে। উৎপাদিত কমলা কিনতে বাগানেই ছুটে আসছেন দূর-দূরান্তের ব্যবসায়ীরা। একই প্লটে আবার চারাও উৎপাদন করছেন। সীমান্ত এলাকায় ফল বাগান হওয়ায় কর্মসংস্থানের পাশাপাশি এলাকার অন্যান্য কৃষকরাও অনুপ্রাণিত হয়ে নিচ্ছেন পরামর্শ।
বাগান দেখতে আসা দর্শনার্থী ওমর ফারুক বলেন, কমলা বাগান দেখতে শহর থেকে এসেছি। আমি দার্জিলিংয়ে বাগান দেখেছি। কিন্তু এখানে কমলা বাগান যে সুন্দর তা দার্জিলিংয়ের বাগানকেও হার মানাবে। আর এই কমলা অনেক মিষ্টি।
আরেক দর্শনার্থী সফিকুল ইসলাম বলেন, পরিবারসহ কমলা বাগান দেখতে এসেছি। আগে কমলা বাগান শুধু ছবিতেই দেখেছি। আজ গাছে ঝুলন্ত কমলা দেখলাম। পুরো বাগানে কমলা ঝুলে রয়েছে। দেখতেই অনেক সুন্দর লাগছে। কমলা কিনে খেলাম। অনেক মিষ্টি ও রসালো।
কমলা বাগানে প্রথম থেকেই কাজ করেন নরেন মোহন। তিনি জানান, আমি প্রথম থেকেই বাগানে কাজ করছি। এখন প্রতিদিন প্রায় এক হাজারের বেশি মানুষ বাগান দেখতে আসে। আমরা বাগানে ১০-১৫ জন কাজ করছি। গাছ থেকে পারার জন্য ৫-৭ জন কাজ করে।
বাগান মালিক আবু জাহিদ মো. ইবনুল ইকরাম জুয়েল বলেন, অর্গানিক পদ্ধতিতে এ বাগান করেছি। এখানে কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। গত মৌসুমে আড়াইশ গাছে ৩শ মণ কমলা ১৫ লাখ টাকা বিক্রয় করেছি। এবার আশা করছি ২৫ লক্ষাধিক টাকার কমলা বিক্রয় করতে পারবো।’
কমলা-মালটা খুব সহজ ও স্বল্প খরচে চাষ করা যায় জানিয়ে এই উদ্যোক্তা বলেন, ১১ বছর আগে জেলা হর্টিকালচার থেকে প্রতি চারা ৫ টাকা দরে ৩০০ চারা ১৫০০ টাকায় ক্রয় করেছিলাম। তাতে সবমিলে তিন বিঘার এই বাগানে চার লক্ষ টাকা খরচ হয়। বর্তমানে আরও দুই বিঘা জমিতে নতুন করে কমলার চাষ শুরু করেছি এবং দুই বিঘা জমিতে মালটার ২০০ গাছ রোপণ করেছি। আশা করছি, আগামী বছরে এই মালটা বাজার জাত করতে পারবো। এসব কমলা ও মালটা চাষ খুব সহজ ও স্বল্প খরচে চাষ করা যায়।’
এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘অরেঞ্জ ভ্যালির কমলা খুবই সুস্বাদু। এ বাগানের কমলা দেশের বিভিন্ন এলাকায় যায় এবং আমাদের দেশে উৎপাদিত কমলা হিসেবে প্রশংসিত হয়েছে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহরিয়ার নজির বলেন, ‘জুয়েলের কমলা বাগান একটি ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছে। তার মতো কেউ এমন কমলা বাগান করতে চাইলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।’
উল্লেখ্য, ভারতীয় দার্জিলিং জাতের কমলা গাছ ৫০ বছর পর্যন্ত ফল দেয়। এটি একটি অর্থকরী ফসল, যা খুব সহজে ও স্বল্প খরচে উৎপাদন করা যায়।
জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘জুয়েলের বাগানটি দেশের একমাত্র দার্জিলিং জাতের কমলার বাগান। এটি ইতোমধ্যে মানুষের কাছে পরিচিতি পেয়েছে অনেক। এখানে শীত মৌসুমে অনেক দূর-দূরান্ত থেকে কমলা কিনতে ও খেতে আসছেন। তাই এটিকে কেন্দ্র করে পর্যটনেরও সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করছি। জেলা প্রশাসন তার পাশে আছে ও থাকবে। এছাড়াও অন্যরাও জুয়েল সাহেবর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে এমন কাজে লাগাতে পারেন।’
মন্তব্য