শুরু হয়েছে অগ্নিঝরা মার্চ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস ছিল উত্তাল ঘটনাবহুল মাস। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ হঠাৎ এক হটকারী সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে বিােভে ফেটে পড়ে বাংলার আপামর জনতা। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর ২৫ মার্চ পর্যন্ত নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন রূপ নেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে।
১ মার্চ, ১৯৭১ পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদে যোগদানের অস্বীকৃতি জানানোর পরিপ্রেেিত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২ মার্চ, ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেন। ২ মার্চ, ১৯৭১ সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি। কারফিউ ভেঙে বিুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন। বিভিন্ন স্থানে মিছিল সমাবেশ, গুলিবর্ষণ। পল্টনে জনসভা ও গণমিছিলের ডাক, ভাষণ দেবেন শেখ মুজিবুর রহমান। ৩ মার্চ, ১৯৭১ বিভিন্ন স্থানে মিছিলে গুলিবর্ষণ, ঢাকায় ২৩ জন নিহত, চট্টগ্রামে ৭৫ জন। ঢাকা, সিলেট ও রংপুরে কারফিউ জারি। ৪ মার্চ, ১৯৭১ চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে সামরিক আইন জারি। চট্টগ্রামে নিহতের সংখ্যা ১২১, খুলনায় নিহত ৬। ঢাকায় কারফিউ প্রত্যাহার। ৫ মার্চ, ১৯৭১ টঙ্গীতে গুলিবর্ষণে ৪ জন নিহত ২৫ জন আহত। চট্টগ্রামে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৩৮। রাজশাহী ও রংপুরে আবার কারফিউ। ৬ মার্চ, ১৯৭১ জাতির উদ্দেশে ইয়াহিয়ার ভাষণ, ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের ডাক। জরুরি বৈঠকে আওয়ামী লীগ। টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ। ৭ মার্চ, ১৯৭১ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণদান।
বাঙালির জাতীয় জীবনে অবিস্মরণীয় এক দিন ৭ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনেই ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে রচিত হয়েছিল রাজনীতির এক ঐতিহাসিক মহাকাব্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এই কথাগুলো উচ্চারণ করে কার্যত স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে বলে দিয়েছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেওয়ার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রম্নর মোকাবিলা করতে হবে।’ ৭ মার্চের এমন ঘোষণা শুধু বঙ্গবন্ধুর পইে দেওয়া সম্ভব ছিল। কারণ দিনে দিনে তিনি নিজেকে চালকের আসনে নিয়ে এসেছিলেন, জাতিকে স্বাধীনতার জন্য তৈরি করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণকে বিশ্বের ইতিহাসের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণের অন্যতম বলে গণ্য করে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর এই ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই ভাষণই বাঙালি জাতিকে প্রস্তুত করেছিল মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও তা প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এরপর বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ৯ মাস রক্তয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর হরমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বাঙালি জাতি হাজার বছরের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির লে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে আসে। এই আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসন, শোসন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গড়ে উঠা আন্দোলন এক পর্যায়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়।
ধারাবাহিকভাবে চলে আসা এই আন্দোলন-সংগ্রাম ১৯৭১-এর মার্চে এসে স্ফুলিংয়ে রূপ নেয়। ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেরে স্বাধীনতার ঘোষনা দেন যা একটি সংগ্রামী জাতির জন্য অত্যন্ত গৌরবের একটি দিন। এর আগেই ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে বাঙালি জাতির উপর নেমে আসে বিভিষিকাময মহুর্ত। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বর্বরচিতভাবে বাংলাদেশের নিরিহ মানুসের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। শুরু করে বিশ্বের ইতিহাসে কলঙ্কজনক গণগত্যা।
এর পরই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষনা দেন এবং পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এই স্বাধীনতার ঘোষণার আগে মার্চে শুরু থেকে স্বাধীনতার জন্য প্রতিদিন বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে চুড়ান্ত পর্যায়ের পরিণতির দিকে আগাতে থাকে। ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের চুড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে জাতিকে দিক দির্দেশনা দেন। বাঙালির এই স্বাধীনতার আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিতে থাকে পাকিস্তানি জান্তারা। ২৬ মার্চে বাঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিব স্বাধীনতার ঘোষণার পর শুরু হয় বর্বর পাকিস্তানি বাহীনর বাঙালি নিধন অভিযান।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে বাঙালি জাতি। অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে পাকিস্তানের এই বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাংলার সর্বস্তরের মানুষ। শুরু হয় রক্তয়ী মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে চলে বাঙালির মরণপণ যুদ্ধ। বীরত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে বাঙালি বিজয়ের দিকে ধাবিত হতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসর্পণ করতে বাধ্য হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে(তৎকালিন রেসকোর্স) মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর(ভারতীয় বাহিনী) যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। রক্তয়ী এ মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মার্চ মাস বাঙালির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ একটি মাস।
নানা বাধা পেরিয়ে স্বাধীনতার ৫১ বছর পার করে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। যাত্রাপথের যাবতীয় আবর্জনাকে পরিষ্কার করে উন্নয়নের গতিকে মসৃণ করতে হবে। এখানে আছে অনেক চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বলিষ্ঠ ও দৃঢ় নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। কোনো অন্যায় বা অসত্যকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। খাদ্যে ভেজাল, মাদক, জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, নিত্যপণ্যের উচিত মূল্য ইত্যাদি সব ইস্যুতে ইতিবাচক পদপে গ্রহণ করে এবং জিরো টলারেন্স নীতিতে অটল থেকে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হবে। একটি জনকল্যাণমূলক আধুনিক ও উন্নত বাংলাদেশ গঠনে সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনোযোগী হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হোক দেশ ও দেশের জনগণ- এই প্রত্যাশাই করছি।
লেখক [সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও গবেষক]
মন্তব্য