রুমান শাহরিয়ার, জামালপুর জেলা প্রতিনিধিঃ কৃষি প্রধান বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে গরু,মহিষ,লাঙল ও জোয়াল। এক সময় জমি চাষের ঐতিহ্যবাহী একটি চিরায়ত পদ্ধতি ছিলো গরু, মহিষ ও লাঙল দিয়ে হালচাষ। কৃষকরা গরু ও মহিষ দিয়ে হালচাষ করতো গ্রামের ফসলি জমিতে। কিন্তু কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে, গ্রাম বাংলার এই হালচাষের ঐতিহ্যটি।
এক সময় দেখা যেত, কাক ডাকা ভোরে গ্রামের কৃষকরা কাঁধে লাঙল-জোয়াল নিয়ে বেরিয়ে পড়তো জমিতে হালচাষের জন্য। ভোরবেলা থেকে দুপুর কিংবা বিকাল পর্যন্ত টানা হাল চাষ করতেন। বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় ও বিজ্ঞানের নতুন নতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের ফলে কৃষকদের জীবনে এসেছে নানা পরিবর্তন। পরিবর্তনের সেই ছোঁয়াও লেগেছে কৃষিতে। লাঙল-জোয়াল কাঁধে নিয়ে ফসলের মাঠে ছুটেচলা এখন আর কৃষকদের দেখা যায় না।
সারা দেশের ন্যায় জামালপুরেও লাঙল দিয়ে জমি চাষ এখন আর চোখে পড়ে না। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে, গ্রামের এই চিরচেনা দৃশ্যটি। বর্তমান যুগে পশু দিয়ে হালচাষের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন যন্ত্রচালিত মেশিন-ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার ইত্যাদি।
আধুনিকতার প্রভাবে নতুন প্রজন্মের অনেকেই জমিতে গরু দিয়ে লাঙল কিংবা মই টানা দৃশ্যের সাথে অপরিচিত। প্রযুক্তির যুগে বিলুপ্তির পথে চিরচেনা এই পদ্ধতি। তাই বর্তমানে কৃষকরা এখন পেশা বদল করে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। ফলে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে গরু, মহিষ, লাঙল, জোয়াল দিয়ে জমিতে হাল চাষ।
জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলাধীন আদ্রা চর গ্রামের কৃষক হারুন বলেন, ‘আগে দিনভর গরু দিয়ে হাল চাষ করতাম। দুপুরে বিশ্রাম নেওয়ার সময় কৃষকরা আমরা বসে হাসি, ঠাট্টা করতাম। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে এখন অল্প সময়ে চাষবাদ শেষ করার জন্য আর আগের সেই পদ্ধতিটি ব্যবহার হয় না। তবে আগের থেকে এখন হালচাষে সময় কম লাগে। আমাদের এলাকায় অনেকেই গরু দিয়ে হালচাষ করতো, এখন আর কেউ করে না। আমি এখনো কিছু জমি গরু দিয়ে হালচাষ করি। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে আমি হালচাষ করে আসছি। পুরোনো অভ্যাসটা ছাড়তে পারিনা বলেই, মেশিন-ট্রাক্টরে পাশাপাশি গরু দিয়ে হালচাষ করে থাকি।’
তিনি আরো বলেন, আমি বয়স্ক মানুষ, ২ টা গরু কিনেছি ১লাখ ১৭ হাজার টাকা দিয়ে। আমার অল্প কিছু জমি গরু দিয়ে হালচাষের মাধ্যমে আবাদ করেছি। এলাকার সবাই এ পদ্ধতি বাদ দিলেও আমি ধরে রেখেছি। সামনের দিনেও এভাবে হালচাষ করে যাব।
জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলার পাটাদহ গ্রামের কৃষক আবদুল্লাহ বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমরা হালচাষের কাজ করে আসছি। বাড়িতে হালচাষের গরু রয়েছে। এক জোড়া হালের বলদ ক্রয় করতে প্রায় ১ লক্ষ ১৫ হাজার থেকে দেড় লক্ষাধীক টাকা লাগে। তাছাড়া হাল চাষের উপকরণ হিসেবে কাঠের তৈরি লাঙল, বাঁশের তৈরি জোয়াল, মই ইত্যাদির নির্মাণ ব্যয় বর্তমানে অনেক। ফলে সময়ের প্রয়োজনে এখন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষিকাজ করছি। এতে সময় ও অর্থ দুটোই সাশ্রয় হয়। এখন অনেক নতুন নতুন আধুনিক মেশিন এসেছে, সেই মেশিন দিয়ে এখানকার লোকজন জমি চাষাবাদ করে। তাই গরু, মহিষ, লাঙল, জোয়াল নিয়ে জমিতে হাল চাষ করা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।
পার্শ্ববর্তী এলাকার কৃষক জাহিদুল ইসলাম বলেন, অন্য জমি গুলো ট্রাক্টর দিয়ে হালচাষ করেছি। কিছু জমিতে সঠিক সময়ে পানি দিতে পারিনি। সেচের জন্য লাইন ধরতে হয়, দিনের বেশী সময় বিদ্যুৎ থাকে না। ট্রাক্টর এ সিজনে আর আসবে না। এজন্য বাধ্য হয়ে গরুর হাল চাষ করতেছি। এক সময় গরু দিয়ে হালচাষ করে চাষাবাদ করতাম।
জামালপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয়ের উপপরিচালক জাকিয়া সুলতানা বলেন, গরু-মহিষ, লাঙল ও জোয়াল ছিলো কৃষকের আশীর্বাদ সরূপ। গরু-মহিষ, লাঙল ও জোয়াল ছিলো আমাদের ঐতিহ্য ও পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতি কৃষি পদ্ধতি। এটি ছিলো অনেক উপকারী এক পদ্ধতি। কারণ লাঙলের ফলা জমির অনেক গভীর অংশ পর্যন্ত আলগা করতো। গরুর পায়ের কারণে জমিতে কাদা হতো অনেক এবং গরুর গোবর জমিতে পড়ে জমির উর্বরতা শক্তি অনেক বৃদ্ধি করতো।
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান সময়ে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি পুরাতন চাষ পদ্ধতিকে আমূল পরিবর্তন করেছে। অধিক ফলনশীল জাতের ফসল চাষ করে কম সময়ে-অল্প খরচে অধিক লাভবান হচ্ছেন শুধুমাত্র আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ছোঁয়াই। আশাকরছি, আগামীতে কৃষিতে আরো পরিবর্তন আসবে যা কৃষকদের ডিজিটাল বানিয়ে দেবে।’
মন্তব্য