ওসমান এহতেসাম: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে কোতোয়ালী চট্টগ্রাম-৯ আসনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই সংসদীয় আসনে পড়েছে দেশের সবচেয়ে বড় ভোগ্যপণ্য বাজার চাক্তাই খাতুনগঞ্জ, মেডিক্যাল কলেজ, নামী-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আদালত, সিটি করপোরেশন, সিডিএ প্রধান কার্যালয়, পুলিশ, ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনার অফিসসহ গুরুত্বপূর্ণ সব প্রশাসনিক অফিস। তাই চট্টগ্রামে সব দলের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ এই আসনটি। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১, ২২, ২৩, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪ এবং ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম- ৯ সংসদীয় আসন। এই আসনে আওয়ামী লীগের যেমন রয়েছে একাধিক প্রার্থীর নাম অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থীর তালিকায়ও রয়েছে সম্ভাব্য ২ জন প্রার্থীর নাম। একইসঙ্গে জাতীয় পার্টির শক্তিশালী প্রার্থী রয়েছে এই আসনে। মর্যাদাপূর্ণ আসনটির বর্তমান শিক্ষা উপমন্ত্রী চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর পুত্র ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। এলাকার রাস্তাঘাট, নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি হাসপাতালের বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে ওঠায় এ আসনটি নিয়ে ক্ষমতাসীনদের দলের মধ্যে তেমন কোন শঙ্কা নেই। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অকপটে স্বীকার করেন যে, এ আসন নিয়ে তাদের কোনো দুশ্চিন্তা নেই। গ্রুপিং রাজনীতি থাকলেও প্রার্থী হিসেবে এখানে ব্যারিস্টার নওফেলের বিকল্প কাউকে মনে করা হচ্ছে না। তবে সাধারণের মধ্যে আলোচনায় রয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের নামও। দলের মনোনয়ন পেলে তিনিও এ আসন থেকে নির্বাচনে আগ্রহী বলে জানা যায় তার ঘনিষ্ঠ সূত্রে। তবে এ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় নাম রয়েছে সাবেক বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসিলাম বিএসসি, সিডিএ সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুলের নামও।
নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এই আসনে অতীতে টানা দুইবার জয়ী হতে পারেননি কেউ। ১৯৯১ সালে এই আসনটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন বিএনপির আবদুল্লাহ আল নোমান। ১৯৯৬ সালে নোমানকে হারিয়ে জিতেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা প্রয়াত এম এ মান্নান। ২০০১ সালে মান্নানের কাছ থেকে আসন পুনরুদ্ধার করেন ধানের শীষের নোমান।
আসন সীমানায় পরিবর্তন আসার পর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ, বিএনপি দুই দলই প্রার্থী বদলে ফেলে। নৌকার মাঝি হন নুরুল ইসলাম বিএসসি ও ধানের শীষে আসেন শামসুল আলম। দুই শিল্পপতির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিলেন নুরুল ইসলাম বিএসসি। ২০১৪ সালের বিএনপিবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিলে মহাজোটের প্রার্থী জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়া উদ্দিন বাবলু সংসদ সদস্য হন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির দলীয় প্রার্থী ডা. শাহাদাত এবং আওয়ামী লীগের নওফেল দুজনই ছিলেন নতুন মুখ। ডা. শাহাদাত জেলে থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভোট পান ১৭ হাজার ৬২৪ ভোট। আর মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল পান ২ লাখ ২৩ হাজার ৬১৪ ভোট। নতুন মুখ নওফেল প্রথমবার নির্বাচনে জয়লাভ করে উপমন্ত্রী হন।ফলে দ্বাদশ নির্বাচনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়েই আওয়ামী লীগের এ প্রার্থী মনোনয়ন তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন।
বিশেষ করে করোনার সময় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালকে আধুনিকায়ন, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা, দরিদ্রদের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, প্রতি রমজানে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে ইফতারসামগ্রী বিতরণ, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মুহূর্তে সরব হওয়া যেমন হেফাজতের বাড়াবাড়ির সময়, সাম্প্রদায়িক শক্তি দুর্গাপূজায় দেশব্যাপী তা-বের সময় একমাত্র ব্যারিস্টার নওফেল ছিলেন স্পষ্টভাষী। এসব কারণে রাজনৈতিক মহলে তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা।
কোতোয়ালি বাকলিয়া এলাকার শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংস্কার ও নির্মাণ এবং চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানটি দৃষ্টিনন্দন করে সেখানে ছয় দফা মঞ্চ নির্মাণ হয় তার উদ্যোগে, যা প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন পলোগ্রাউন্ডে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের সমাবেশস্থল থেকে। লালদীঘি ময়দানে ছয় দফা মঞ্চ ও টেরাকোটার স্থাপনা করে প্রশংসিত হয়েছেন নওফেল। তাই আওয়ামী লীগের কাউকেই তার প্রতিপক্ষ ভাবা হচ্ছে না।
অপরদিকে বিএনপি যদি নির্বাচনে আসে তাহলে তাদেরও মহানগর বিএনপির ডা. শাহাদাত হোসেন ছাড়া বিকল্প প্রার্থী নেই। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে এক দশকের বেশি সময় ধরে সক্রিয় শাহাদাত। চিকিৎসকদের এই নেতা ২০১১ সালে চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন; ২০১৭ সালে দায়িত্ব পান সভাপতির। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে ছাত্ররাজনীতিতে উঠে আসা এই নেতা ইতিপূর্বে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। এ আসনে নির্বাচন করার আগ্রহের কারণে সাংগঠনিক সম্পাদক পদ ছেড়ে দিয়ে চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি পদে আসেন। এ আসনের বাকলিয়া অংশটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ডা. শাহাদাত তার রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে ওই এলাকায় সরব রয়েছেন। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের স্নেহধন্য হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত নগরীর আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন আন্দোলন সংগ্রামের রাজনীতিতেও এখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ও করোনার সময় এবং পরবর্তী দুস্থ পরিবারের সদস্যদের আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়াসহ মানবিক কাজে নিজের অবস্থান দৃঢ় করেছেন এই বিএনপি নেতা। তাছাড়া নেতা কর্মীদের বিপদে-আপদে সবসময় পাশে থেকে তৃণমূলের আস্থা অর্জন করেছে এই নেতা। তাই তাকে ছাড়া চট্টগ্রাম-৯ আসনের বিকল্প কেউ নেই বলে জানান তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।
এক সময় নগর বিএনপির রাজনীতি খসরু-নোমান ও মীর নাছিরের বলয়ে তিন গ্রুপে বিভক্ত থাকলেও প্রায় ১৫ বছর যাবত ডা. শাহাদাতের বলয়টি বেশ শক্ত অবস্থানে পৌঁছেছে। দলটির বড় একটি অংশ তার সঙ্গে থাকায় বিএনপির শীর্ষ নেতারাও তাকে মনোনয়ন দেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক বলেই প্রতীয়মান। এছাড়া মনোনয়ন চাইতে পারেন আবদুল্লাহ আল নোমানও।
এদিকে দেশের টালমাটাল রাজনীতিতে সবসময় বড় ইস্যু হিসেবে কাজ করে জাতীয় পার্টি। প্রচলিত আছে, জাতীয় পার্টি যে দলের সাথে জোট করবে-সে দল সরকার গঠন করে। এমন বাস্তবতায় রাজনৈতিক বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই জাতীয় পার্টিকে পাশে চায়। তবে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের এখনই জোট করার পক্ষে নন। নির্বাচনের কাছাকাছি সময়ে জোট করার পক্ষে অনড় দলটি। তাই বলে নির্বাচনী প্রস্তুতিতে পিছিয়ে নেই জাতীয় পার্টি। এই আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে আছেন একাদশ জাতীয় সংসদের প্রয়াত সংসদ সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, বাংলা ভাষা (মরণোত্তর) পদক প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. মাসুদা এম রশীদ চোধুরী এমপির এক মাত্র সন্তান ব্যারিস্টার সানজীদ রশীদ চৌধুরী। যিনি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এর বিশেষ উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের আস্থাভাজন বলেও জানা যায়। তাঁকে প্রার্থী করতে স্থানীয় জাতীয় পার্টি ও অঙ্গ সংগঠনের বেশির ভাগ নেতাকর্মী দলের নীতি-নির্ধারকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে।
জাতীয় পার্টি সূত্রগুলো জানায়, চট্টগ্রাম নগরীর ১৬টি থানা এলাকার তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেছেন দীর্ঘদিন ধরেই। এছাড়া চট্টগ্রাম-৯ আসনে তার একাধিক বাড়ি থাকায় আসনের (বাকলিয়া- কোতোয়ালী)কে ঘিরে তার কর্মকাণ্ডের সক্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়। সে সুবাদে দলের তৃণমূলে তাঁর আলাদা একটি গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তাছাড়াও তার পিতা-মাতা এমপি-মন্ত্রী থাকায় বংশের গৌরবউজ্জ্বল অবদানের জন্য সাধারণ জনগণের আগ্রহ রয়েছে তার প্রতি।বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে চট্টগ্রাম-৯ আসনে নাঙ্গলের প্রার্থী হিসেবে দলও তাঁকে গুরুত্ব দিচ্ছে।
ব্যারিস্টার সানজীদ রশীদ চৌধুরী জাতীয় পার্টি সরকার থাকাকালীন সময় সরকারের অগ্রগতি ও উন্নয়নের বার্তা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রায় ৩ বছর ধরে গণসংযোগ, লিফলেট বিতরণ, মাদক নিয়ন্ত্রণে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাথে সমন্বয় করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মাদক বিরোধী শপথ বাক্য পাঠ, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সমন্বয়ে বেকার যুবকদের প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমাতে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, শ্রমিকদের ন্যায্য বেতনের দাবিতে বারবার শিল্প প্রতিষ্ঠান মালিকদের সাথে বৈঠক, মা দিবস ও পথসভা করছেন। নাঙ্গলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করেছেন।
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জীবনে আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। আমার পরিবারে বাবা-মা এমপি-মন্ত্রী হয়ে দেশের মানুষের জন্য আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধসহ নারীদের ক্ষমতায়ন বৃদ্ধিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি আমার মাও আন্দোলন সংগ্রাম করে গেছেন। আমি তার সন্তান। সুযোগ পেলে চট্টগ্রাম-৯ আসনের মানুষের উন্নয়নে আজীবন কাজ করে যাব। এ দেশে যখন জন্মগ্রহণ করেছি, এ দেশের মাটি ও মানুষের কাছে ঋণী। ঋণের দায়বদ্ধতা থেকে দেশের মানুষের সেবা করে যেতে চাই।
এ আসন থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন, জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রয়াত মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর ছেলে আশিক আহমেদ।আশিক আহমেদ জাপার কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব পদে আছেন। তার বাবা জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু যেহেতু এ আসনের এমপি ছিলেন, তাই বাবার এ আসনটি পুনরুদ্ধার করতে চান তিনি।
মন্তব্য