তাইওয়ান ঘিরে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েনের মধ্যেই সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী শনিবার। এ নির্বাচনকে চলতি বছরের অন্যতম আলোচিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। দ্বীপটির জনগণ নতুন নেতা নির্বাচনের মাধ্যমে ঠিক করবেন তাঁদের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক চীনের সঙ্গে কেমন হবে। তাঁদের এ সিদ্ধান্ত ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বাইরেও প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯৬ সালে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পর থেকে মূলত দুটি রাজনৈতিক দল ডিপিপি ও কেএমটি প্রতি চার বছর পর জয়ী হয়ে আসছে। তবে দেশটিতে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও ধীর অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে ক্ষমতাসীন দল ডিপিপির প্রতি আস্থা কমেছে তাইপের জনগণের।
তাইওয়ানে প্রতি চার বছর অন্তর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সংবিধান অনুযায়ী দুই মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারে না কেউ।
এ নির্বাচন ঘিরে একটি নাম বেশি আলোচিত হচ্ছে। তিনি হচ্ছেন তাইওয়ানের ভাইস প্রেসিডেন্ট লাই চিং তে। এরপরই অপর যে দুই মূল প্রার্থী রয়েছেন, তাঁরা হলেন কুয়োমিনতাং (কেএমটি) পার্টির হো ইয়ু ইহ এবং তাইওয়ান পিপলস পার্টির (টিপিপি) কো ওয়েন–জে। হো ইয়ু ছিলেন নিউ তাইপে সিটির জনপ্রিয় মেয়র এবং সাবেক পুলিশপ্রধান। দেশটির বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তাইওয়ানের স্বাধীনতার বিপক্ষে।
আর টিপিপির কো ওয়েন ছিলেন তাইপের সাবেক মেয়র। ২০১৯ সালে তিনি দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। যেসব ভোটার বড় দুটি রাজনৈতিক দলের ভূমিকায় বিরক্ত এবং নতুন কিছু চান, তাঁদের কাছে টানার চেষ্টা করছেন কো–ওয়েন। তবে চীন ইস্যুতে ডিপিপি এবং কেএমটির তুলনায় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। কারণ, তিনি (চীনকে) প্রতিরোধ আবার চীনের সঙ্গে যোগাযোগও চান।
সাই ইং ওয়েনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে দুই মেয়াদে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর তাইনানের জনপ্রিয় মেয়র ছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি পূর্বসূরি সাইয়ের পথই কঠোরভাবে অনুসরণ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সাইয়ের নীতি হলো চীন থেকে বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড হিসেবে তাইওয়ানকে স্বাধীন একটি দেশ। তাই সাইয়ের নীতি কী হবে, তা আর বলার দরকার নেই। অথচ চীন ২ কোটি ৪০ লাখ জনগোষ্ঠীর তাইওয়ানকে নিজেদের ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে। প্রয়োজনে তাইওয়ানকে জোরপূর্বক একীভূত করার হুমকিও দিয়ে রেখেছে বেইজিং।
লাই রাজনীতিতে আসার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন চীনের কাছ থেকেই। তিনি তাইওয়ানের উত্তরাঞ্চলের একটি দরিদ্র গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন। সেই গ্রামে ছিল কয়লাখনি। তাঁর বাবা ছিলেন কয়লাশ্রমিক। তিনি যখন ছোট, তখনই তাঁর বাবা মারা যান। এরপর তাঁর মা একাই ছয় সন্তানকে বড় করেন। লাইয়ের মুখপাত্রের ভাষ্য, শৈশবে দেখা লাইয়ের দুঃখকষ্টই তাঁকে সুবিধাবঞ্চিত ও সংখ্যালঘুদের প্রতি সমব্যথী হতে শিখিয়েছেন। তিনি তাইওয়ানের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। পরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনস্বাস্থ্যের ওপর স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।
চার দশকের সামরিক শাসন থেকে বেরিয়ে আসার এক দশক পর ১৯৯৬ সালে তাইওয়ানে প্রত্যক্ষ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন থেকেই ডিপিপির প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন লাই। কিন্তু চীন যখন তাইওয়ানে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে দ্বীপটির উপকূলীয় সাগরে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করে, তখন তাঁর মনে হয়েছে, তাঁর নিজেরই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা উচিত। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে লাই লিখেছেন, ‘তাইওয়ানের গণতন্ত্রে অংশ নেওয়া আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে এবং যারা এই গণতন্ত্রকে নষ্ট করতে চায়, তাদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।’
এবারের নির্বাচনে লাইয়ের সঙ্গে থাকা মূল প্রতিদ্বন্দ্বী অপর দুজন চীনঘেঁষা। জনমত জরিপে লাই কিছুটা এগিয়ে থাকলেও তিনি বিজয়ী হবেন, এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। একসময় তাঁর দল তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পেরেছিল। কিন্তু আট বছর ধরে ক্ষমতায় থাকলেও দলটি সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। নতুন কিছু তেমন করতে পারেনি। সেখানে মূল্যস্ফীতি যেভাবে হয়েছে, মানুষের বেতন সেভাবে বাড়েনি। অথচ বাড়িভাড়া বেড়েছে ব্যাপক। এ ছাড়া লাই তাঁর দলের সিদ্ধান্তে অনড় থাকবেন। তাঁর দল ২০২৫ সালের মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিতে চায়। এতে জ্বালানির দাম বাড়া নিয়ে সবার মধ্যে একধরনের ভীতি রয়েছে। এ ছাড়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটি, তা হলো চীন কখনো ডিপিপি সরকারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক স্থাপন করবে না বলে অনেকটা নিশ্চিত।
লাই ২০১৭ সালে নিজেকে ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতার জন্য বাস্তববাদী কর্মী’ হিসেবে অভিহিত করে চীনের ক্ষোভ উসকে দিয়েছিলেন। বেইজিংয়ের কর্মকর্তারা সম্প্রতি তাঁকে ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতার নিয়ে মিথ্যাচারকারী’ এবং ‘চূড়ান্ত পর্যায়ের দুর্বৃত্ত’ বলে অভিহিত করেছেন। তবে লাইয়ের মন্তব্য নিয়ে শুধু যে চীনই শঙ্কায় রয়েছে, এমনটা নয়—যুক্তরাষ্ট্রও আছে।
লাই জিতে গেলে তাইওয়ান প্রণালিতে আরও উত্তেজনা ছড়াবে বলে আশঙ্কায় আছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। লাইয়ের লাগামহীন কথাবার্তা কারণে যুক্তরাষ্ট্রের এ আশঙ্কা অমূলক নয়। গত বছর তিনি বলেছিলেন, তিনি আশা করেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট এমন কিছু করবেন, যাতে নজির ভেঙে যাবে এবং চীনও ফুঁসে উঠবে, আর তা হলো তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট একদিন ‘হোয়াইট হাউসে ঢুকতে পারবেন’। যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের প্রতি প্রধান সমর্থক হলেও সে তুলনায় চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক অনেক বেশি।
ভোটে জিতলে লাইকে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। কারণ, তিনি চাইবেন, তাইওয়ানের ভঙ্গুর সার্বভৌমত্ব শক্তিশালী হোক। এ কাজে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র তাদের সহায়তা করতে পারে। তিনি চীনের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতাও কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। গত বছরের প্রথম ১১ মাসের চিত্র দেখলে বোঝা যায়, তাইওয়ানের রপ্তানি আয়ের ৩৫ শতাংশ এসেছে চীনের মূল ভূখণ্ড ও হংকং থেকে। লাই আশাবাদী, তিনি ক্ষমতায় এলে তাইওয়ান অন্যান্য দেশের সঙ্গে আরও বাণিজ্য চুক্তি করতে পারবে এবং বিশ্বজুড়ে ‘গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্ব আরও জোরদার করতে পারবেন। একই সঙ্গে তিনি এও বলেছেন, প্রণালির ওই পারের শক্তির সঙ্গে আলোচনায় বসতে তিনি এখনো প্রস্তুত।
অনেক তাইওয়ানবাসীর আশা, চীন হয়তো তাদের দেশের মানুষের ওপর থেকে তাইওয়ান সফরের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে। আর এর মধ্য দিয়ে দ্বীপটির অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু লাই জিতলে তাইওয়ানকে ঘিরে চীনের হুমকি চলতেই থাকবে। তাইওয়ান আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এ সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছেন বিরোধীরা। তাঁরা বলছেন, লাইয়ের হাতে ক্ষমতা গেলে তাইওয়ান হবে অনিরাপদ। লাই অবশ্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের চীনের পুতুল বলেই মনে করেন। তিনি বলছেন, চীনঘনিষ্ঠ দুজন ক্ষমতায় এলে চীনের ব্যাপক প্রভাব বাড়বে। আর এর ফলে তাইওয়ানের এত কষ্টে অর্জিত গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাবে।
মন্তব্য