শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪
 

বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি প্রণোদনা/ নগদ সহায়তায় অনাকাঙ্খিত পরিবর্তনে বিজিএমইএ এর প্রেস বিজ্ঞপ্তি

কণ্ঠস্বর ডেস্ক, ঢাকা
প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারী ২০২৪

---

বাংলাদেশ ব্যাংক বিগত ৩০ জানুয়ারী ২০২৪ তারিখে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানির বিপরীতে রপ্তানি প্রণোদনা/ নগদ সহায়তা বিষয়ক একটি সার্কুলার জারি করেছে, যার মাধ্যমে প্রচলিত নগদ সহায়তার হার ও কাঠামোতে কিছু অনাকাঙ্খিত পরিবর্তন আনা হয়েছে। এই পরিবর্তন শিল্পের জন্য মোটেও সহায়ক ও সময়োপযোগী নয়, বরং এটি শিল্পে অনাকাঙ্খিত ঝুঁকি ও বিপর্যয় ডেকে আনবে।

উল্লেখিত সার্কুলারে ৫টি প্রধান রপ্তানী পন্যের উপর নগদ সহায়তা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। পন্যগুলো হল- টি শার্ট, সুয়েটার, নীটেড শার্ট, পুরুষদের আন্ডার গার্মেন্ট, এবং ওভেন ট্রাউজার ও জ্যাকেট। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই ৫টি পন্যের রপ্তানি মূল্য ছিল ২৫.৯৫ বিলিয়ন ডলার, যা আমাদের মোট পোশাক রপ্তানির ৫৫.২২%।

শুধুমাত্র ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রণোদনা ছাড়া বাকি সব প্রনোদনার হার ২৫%-৫০% কমানো হয়েছে। লক্ষ্যনীয় যে, যদিওবা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রণোদনার হার কমানো হয়নি, তবে অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানার উৎপাদন ও রপ্তানি কিছু বেসিক পন্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, বিশেষকরে টি-শার্ট, ট্রাউজার ও সুয়েটার। এই পন্যগুলো সামগ্রিক প্রনোদনা ব্যবস্থা থেকে বাদ দেয়ায় মূলত এসব পন্য রপ্তানিকারী ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলো কোন প্রনোদনাই পাবে না। আমাদের মোট পোশাক রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠিানের মধ্যে ৬০%ই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শ্রেনির।

এক্ষেত্রে আরও উল্লেখ্য যে, WTO এর ASCM বিধান অনুযায়ী এই ৫টি পন্যের উপর নগদ সহায়তা বাদ দেয়া হয়েছে বলে সার্কুলারে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী সময়ে WTO Complaint পদ্ধতিতে বিকল্প প্রনোদনা প্রবর্তনের বিষয়ে সার্কুলারটিতে কোন উল্লেখ নেই, যদিওবা অনেক মধ্যম আয়ের দেশ তাদের শিল্পের জন্য সরাসরি প্রনোদনা না দিয়ে বিকল্প প্রনোদনা দিয়ে আসছে। বিকল্প প্রনোদনা প্রদানের বিষয়টি আমাদের দেশেও সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। বিকল্প ব্যবস্থা না করে হঠাৎ প্রচলিত ব্যবস্থা কর্তন শিল্প ও অর্থনীতির জন্য সহায়ক পদক্ষেপ বলে আমরা মনে করি না।

আবার আমরা প্রধান যে ৩টি অপ্রচলিত বাজারে ভাল করছি, অর্থাৎ জাপান, ভারত ও অষ্ট্রেলিয়ায় রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন বাজারের রপ্তানি প্রণোদনাটি বাদ দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই ৩টি বাজারে আমাদের পোশাক রপ্তানি ছিল ৩.৭৭ বিলিয়ন ডলার, যা আমাদের মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ৮%। বিগত প্রায় ১৪ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম, বিনিয়োগ ও সরকারের সহায়তার মাধ্যমে আমরা এই বাজারগুলো তৈরি করতে পেরেছি। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে যখন আমাদের প্রধান দুটি বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে রপ্তানি কমেছে যথাক্রমে ৫.৬৯% ও ১৭.০৫%, তখন প্রনোদনা থেকে বাদ পড়া তিনটি নতুন বাজারে আমাদের প্রবৃদ্ধি ছিল ৪৩.৫৬%। এই বাজারগুলো বাদ দেয়ার ফলে সেখানে আমাদের রপ্তানী বিপর্যস্ত হবে।

সামগ্রিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, উল্লেখিত সার্কুলারের ফলে পোশাকখাতে প্রচলিত প্রনোদনার প্রায় ৭০% কর্তন করা হয়েছে। যেখানে চলতি অর্থবছরের শুরুতে গত ২৪ আগষ্ট ২০২৩ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলারের (এফই সার্কুলার নং-১৩) মাধ্যমে সকল প্রনোদনার হার ও কাঠামো ঘোষণা করে তা চলতি অর্থবছরের ৩০ জুন ২০২৪ তারিখ পর্যন্ত জাহাজীকৃত পন্যের উপর কার্যকর থাকবে বলে ঘোষণা করল, যেখানে এই প্রনোদনাগুলো বেশকিছু বছর যাবৎ কার্যকর রয়েছে, যেখানে ঘোষিত প্রণোদনা অনুযায়ী কারখানাগুলো অর্ডার কনফার্ম করেছে এবং বিনিয়োগ করে ফেলেছে, সেখানে স্টেকহোল্ডারদের সাথে কোন প্রকার পূর্ব আলোচনা ছাড়া হঠাৎ এরকম একটি গুরুতর সিদ্ধান্ত শিল্পকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করবে।
---
বিশেষ করে যখন আমাদের প্রধান রপ্তানী বাজারগুলোর পোশাক আমদানি ও চাহিদা ভাল নয়, এবং স্থানীয় পর্যায়ে আমরা উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির চাপে আছি তখন এরকম একটি পদক্ষেপ শিল্প ও অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের যে নিম্নমূখী প্রবনতা ও ব্যালেন্স অব পেমেন্টে যে চাপ রয়েছে, সেই বাস্তবতায় এরকম একটি পদক্ষেপ আমাদের অর্থনীতির জন্য মোটেই সহায়ক নয়, বরং তা এই সংকটকে আরও ঘনিভূত করবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, করোনা মহামারির পর সরকারের সহযোগিতায় ও উদ্যোক্তাদের নিরলস প্রচেষ্টায় আমরা যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিলাম ঠিক তখন বিশ্ব অর্থনীতিতে শুরু হয় অস্থিরতা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানী সংকট, ও জ্বালানী ও খাদ্য পন্যের উচ্চ মূল্যস্ফিতির কারনে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা বিরাজ করছে। উন্নত দেশগুলোতে মূল্যস্ফিতি ও ব্যাংক ঋণের সুদ বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতা ও পোশাকের চাহিদা কমেছে। সম্প্রতি ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ, লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর অনিরাপত্তা ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা আমাদের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারন। ইতিমধ্যে আমাদের রপ্তানিখাতে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইউরোস্ট্যাট ও অটেক্সার তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ এর জানুয়ারী-নভেম্বর সময়ে ইউরোপের বৈশ্বিক পোশাক আমদানী কমেছে ১৩% ও যুক্তরাষ্ট্রের কমেছে ২২%। একই সময়ে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের আমদানী কমেছে ১৭.৫২% এবং যুক্তরাষ্ট্রের কমেছে ২৫%। ইউরোপে জুলাই-নভেম্বর ২০২৩ সময়ে টি-শার্টের গড় দরপতন হয়েছে ১২.৫৫%, সুয়েটারের দরপতন হয়েছে ১২.৬৩% এবং ট্রাউজারের দরপতন হয়েছে ৫.৭০%। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে টি-শার্টের গড় দরপতন হয়েছে ১৭.৮৮%, সুয়েটারের দরপতন হয়েছে ৯.৭৫% এবং ট্রাউজারের দরপতন হয়েছে ৬.৮৪%; আর বাদ পড়া ৫টি পন্যের মধ্যে এই ৩টি পন্য রয়েছে।

অপরদিকে, বিগত ৫ বছরে ডিজেলের মূল্য বেড়েছে ৬৮%, গ্যাসের মূল্য বেড়েছে ২৮৬.৫%, বিদ্যুতের মূল্য বেড়েছে ২১.৪৭%। এর ফলে আমাদের পরিবহন খরচ সহ সার্বিক উৎপাদন খরচ বেড়েছে। জুলাই ২০২৩ থেকে ব্যাংক সুদ বেড়েছে। আর জানুয়ারী থেকে নূন্যতম মজুরী বেড়েছে ৫৬%। নতুন ন্যূনতম মজুরী বাস্তবায়নের পর শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে, অধিকাংশ ক্রেতাই মূল্য সমন্বয় করছেন না। ফলে পন্যের দরপতন, চাহিদা হ্রাস এবং বর্ধিত উৎপাদন খরচ মিটিয়ে টিকে থাকাটি যখন কঠিন হয়ে পড়েছে, তখন এই পদক্ষেপটি শিল্পকে এক গভীর সংকটে ফেলবে।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে শিল্প ও শ্রমখাতে যেন কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা তৈরি না হয় সেজন্য আমাদের কারখানাগুলো আর্থিক চাপে থাকলেও ব্রেক-ইভেন মূল্য এমনকি লোকসান দিয়েও উৎপাদন ও শ্রমিকের কর্মসংস্থান ধরে রেখেছে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল সরকার নূ্যনতম মজুরী বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে পোশাকখাতের জন্য বিশেষ নীতি সহায়তা প্রদান করবে।

আরেকটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, আমাদের প্রনোদনা প্যাকেজ যখন কাট-ছাঁট করা হচ্ছে তখন আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো তাদের শিল্পের জন্য সহায়তা বৃদ্ধি করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ভিয়েতনামের এফটিএ গত বছর কার্যকর হয়েছে, ফলে ইউরোপে তাদের শুল্ক প্রায় ৮০% কমে গেছে, যা ২০৩০ নাগাদ শুল্কমুক্ত হবে। পক্ষান্তরে, ২০২৯ এর পর আমরা ডাবল ট্রান্সফরমেশনের চ্যালেঞ্জে পড়ব। এরকম একটি সময়ে WTO বিধান অনুযায়ী যতদিন আমরা স্বল্পোন্নত দেশের সুবিধা ভোগ করছি ততদিন পর্যন্ত নগদ সহায়তা সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে দেয়া অধিক যুক্তিযুক্ত ছিল, যার মাধ্যমে শিল্পকে আমরা টিকিয়ে রাখতে পারতাম।

আমরা আশাকরি বর্তমান বৈশ্বিক সংকট মোকাবেলা করে আমাদের অর্থনীতিকে ২০৪১ সাল নাগাদ একটি উন্নত অর্থনীতির দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সরকার শিল্প ও দেশের স্বার্থে এই পদক্ষেপটি পুনঃবিবেচনা করবে।

এস এম মান্নান (কচি)
ভারপ্রাপ্ত সভাপতি
বিজিএমইএ

মন্তব্য

সর্বশেষপঠিত

এলাকার খবর

Developed By: Dotsilicon