শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪
 

রাঙ্গুনিয়ায় বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের আশঙ্কাতেও থেমে নেই পাহাড় নিধন

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৪

 ছবি : যুগের কন্ঠস্বর

রাঙ্গুনিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি: পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে পাহাড় কাটার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পাহাড়খেকোরা পাহাড় কেটে সাবাড় করেছে প্রতিনিয়ত। এপর্যন্ত রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কাটার সরঞ্জাম জব্দ ও অর্থ দন্ড করার সত্ত্বেও আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মহোৎসব সাথে চলছে পাহাড় কাটার প্রতিযোগিতা।

(শনিবার) ১৩ জুলাই সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাহাড় নিধনের মহোৎসবে মৃত্যুর মিছিলে অংশ নিতে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর এলাকায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর মসজিদ ভিটা এলাকায় আবছার নামে এক ব্যক্তি তার ঘরের পেছনে ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড় কেটে সাবাড় করেছে।

টানা বৃষ্টিতে রাঙ্গুনিয়ায় পাহাড় ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কিন্তু এর মাঝেই থেমে নেই পাহাড় কাটার মহাযজ্ঞ। অথচ দুর্ঘটনা এড়াতে পাহাড়ে বসবাসকারী পরিবারগুলোকে সরে যেতে মাইকিং করেছে ফায়ার সার্ভিস। বৃষ্টিতে একদিকে পাহাড় ধসের শঙ্কা, অন্যদিকে চলছে পাহাড় নিধন। ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি দুর্ঘটনায় প্রাণহানির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ওই পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত বাসিন্দাদের মাটির ঘর গুলো পাহাড় ধসে যেকোনসময় ঘটতে পারে প্রাণহানির মতো ঘটনা। একইচিত্র দেখা গেছে এই গ্রামের আরও একাধিক স্পটে। অন্যদিকে পাশ্ববর্তী ইসলামপুর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড খলিফাপাড়া এলাকায় দুর্গম এলাকায় সড়কের পাশ থেকেই বিশালাকার পাহাড় কেটে সাবাড় করা হয়েছে। পাহাড়ের গায়ে এস্কেভেটরের চিহ্ন দেখে বুঝা যায়, সম্প্রতিই পাহাড়টা নির্দয়ভাবে কাটা হয়েছে। পাহাড়ের উপরে থাকা ব্যাপক গাছসহ বিপদজনকভাবে কাটা পাহাড়টা যেকোন সময় ধসে পড়ে পাশের বসতঘরসহ সড়কে চলাচলরত মানুষের প্রাণহানির আশংকা রয়েছে। তবে পাহাড় কাটার সাথে সম্পৃক্ত কে এই প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন স্থানীয়রা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় ফারুখ চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি প্রভাব ও ভয়ভীতি দেখিয়ে এসব পাহাড় কাটছেন বলে জানা যায়। শুধু পাহাড়ই নয়, এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৬ নং ওয়ার্ড বাসিন্দাদের সবচেয়ে বড় কবরস্থান দখল করে সেখানে গাছের চারা লাগিয়ে দেয়ারও অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। আরএস এবং বিএস খতিয়ানে কবরস্থান হিসেবে উল্লেখ থাকার পরও কবরস্থানের জন্য নির্ধারিত পাহাড়টি জোরপূর্বক দখল করায় ক্ষোভে ফুঁসছেন এলাকাবাসী। তবে প্রভাবশালী হওয়ায় প্রতিবাদ করার জন্য কেউই সাহস পাচ্ছেন না বলে সরেজমিনে জানা যায়। তবে তাৎক্ষণিক তার সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে কেউ তার পরিচয় কিংবা মুঠোফোন নাম্বার দিতে রাজি হননি।

এছাড়াও উপজেলার একাধিক স্থানে সিন্ডিকেট করে অভিনব পন্থায় চলছে পাহাড় ও কৃষি জমির টপ সয়েল কাটার মহা উৎসব। পরিবেশ অধিদফতরের কঠোর নজরদারিতেও থামানো যাচ্ছে না পাহাড় ও টপ সয়েল কাটা মহোৎসব। উল্টো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অগোচরে বেড়েই চলেছে একের পর এক পাহাড় ও টপ সয়েল কাটার ঘটনা। ইটের ভাটা, পুকুর ভরাট ও ইমারত নির্মাণের প্রতিযোগিতায় পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষাকারী পাহাড় ও টপ সয়েলকে উৎসবের বলী হিসেবে দিচ্ছে বিসর্জন।

তবে এই ব্যাপারে জানতে চাইলে ইসলামপুর ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিন চৌধুরী মুঠোফোনে জানান, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কবরস্থান দখল থেকে বিরত থাকার জন্য মৌখিকভাবে বলা হয়েছে। এরপরও সে গাছ লাগিয়ে দিয়েছে। তাকে ডেকে এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইসলামপুরে পাহাড় কাটার কারণে সড়কগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। বিষয়গুলো প্রশাসনকে বিভিন্ন সময় জানানো হয়েছে। আশাকরি প্রশাসন এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৩ জুন উপজেলার ইসলামপুর ও দক্ষিণ রাজানগর এলাকায় পাহাড় ধসে মাটিচাপায় মারা গিয়েছিলো নারী- শিশুসহ ২৩ জন মানুষ। পাহাড় ধস ট্রাজেডির সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও কাঁদায় সবাইকে। কিন্তু এরপরও কমেনি পাহাড়ের পাদদেশে মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস। বরং সারাবছর ধরে বেপরোয়াভাবে কাটা হয় পাহাড়। দিন দিন বাড়ছে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস। উপজেলার ১৫ ইউনিয়নে ১৫ হাজার একর বন ভূমি বা পাহাড় রয়েছে। যেখানে ঝুঁকি নিয়ে থাকছেন ১০ হাজার পরিবারের অন্তত অর্ধলাখ বাসিন্দা। এই কয়বছরে তাদের সরানোর দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ নেই প্রশাসনের। অন্যদিকে নিম্ন আয়ের এসব বাসিন্দারা ঝুঁকি আছে যেনেও বাধ্য হয়ে পাহাড়ে পরিবার নিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানান তারা।

এই ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রায়হান মেহবুব বলেন, সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবিলায় সব রকম প্রস্তুতি নিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। সব ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য। যারা পাহাড় কাটার সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ এ বলা হয়েছে, পাহাড় কাটা আমলযোগ্য অপরাধ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পূর্ব অনুমতি ছাড়া কোনও সরকারি, আধা-সরকারি, সায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যক্তি পাহাড় কাটতে বা নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না। যদি কেউ এটি অমান্য করে, তবে তাকে অথবা ওই প্রতিষ্ঠানকে দুই বছর কারাদণ্ড অথবা ২ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। ফের একই অপরাধ করলে, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ১০ বছর কারাদণ্ড অথবা ১০ লাখ জরিমানা গুণতে হবে।

অন্যদিকে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-১৯৯৬ তে বলা হয়েছে, পাহাড় কাটা অথবা মোচনের জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র অবশ্যই নিতে হবে। ২০০২ সালের ৯ মার্চ পরিবেশ অধিদফতর এই সম্পর্কিত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। যেখানে বলা হয়েছে পাহাড় কর্তন ও মোচনের ক্ষেত্রে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা -১৯৫২ এবং ১৯৯৬ অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।

মুবিন বিন সোলাইমান

রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি

মন্তব্য

সর্বশেষপঠিত

এলাকার খবর

Developed By: Dotsilicon