বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪
 

পৌনে তিনশ বছরের ঐতিহ্যবাহী বাকরখানি

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ৬ নভেম্বর ২০২৪

---

ঊর্মিলা আক্তার ঝিনুক
আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য ও আদি পুরুষের সাথে যেসব খাদ্য এখনো বিরাজমান তার মধ্যে বাকরখানি অন্যতম।এটি ময়দা দিয়ে তৈরি একটি বিশেষ খাবার। এটি বাংলাদেশের পুরান ঢাকাবাসীদের সকালের নাস্তার মেনুতে বেশ জনপ্রিয় একটি খাবার। ময়দার খামির থেকে রুটি বানিয়ে সেটা আবার মচমচে বা খাস্তা করে ভেজে বাকরখানি তৈরি করা হয়।আপনি যেমন চাইবেন তেমনি পাবেন,ছোট বা বড় বিভিন্ন আকারের বাকরখানি পাওয়া যায় পুরান ঢাকায়। বাকরখানি তে সাধারণত ময়দার সাথে স্বাদবর্ধক আর কিছু দেওয়া হয়না।

তবে চিনি দেওয়া বাকরখানিও একেবারে বিরল নয়।বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাকরখানি রসালো এবং বেশ সুমিষ্ট। ঢাকার একসময়ের প্রসিদ্ধ রুটির মধ্যে অন্যতম ছিল এই বাকরখানি।এখনও পুরনো ঢাকার কোনো কোনো অঞ্চলে তৈরি হয় বাকরখানি। আর এই বাকরখানি শুখা’ বা শুকনো নামে পরিচিত।বাকরখানির উৎপত্তি স্থান হল আফগানিস্তানে।আফগানিস্তান এবং রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় এর প্রচলন এখনো বিদ্যমান।ঢাকায় সর্বপ্রথম বাকরখানির দোকান গড়ে উঠেছিল লালবাগ।সেই থেকে বাকরখানির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক প্রায় পৌনে তিন শ বছরের।বাংলাদেশে বাকরখানির প্রচলন নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন অভিমত ।তবে বাকরখানি রুটির নামের পেছনে আছে এক করুণ ইতিহাস।

বিশেষজ্ঞদের মতে জমিদার আগা বাকের তথা আগা বাকির খাঁর নামানুসারে এই রুটির নাম দেয়া হয়েছে ।নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁর দত্তক ছেলে ছিলেন জনাব আগা বাকের। প্রখর মেধার অধিকারী আগা বাকের যুদ্ধবিদ্যাতেও পারদর্শী ছিলেন। রাজধানী মুর্শিদাবাদের নর্তকী খনি বেগম এবং আগা বাকের দুইজন দুইজনার প্রেমে পড়েন। কিন্ত উজিরপুত্র নগর কোতোয়াল জয়নাল খান ছিল পথের কাঁটা, সে খনি বেগমকে প্রেম নিবেদন করলে তিনি জয়নাল খানকে প্রত্যাখান করেন। প্রত্যাখ্যাত হয়ে জয়নাল খনি বেগমের ক্ষতির চেষ্টা করে এবং খবর পেয়ে বাকের সেখানে যান এবং তলোয়ারবাজিতে জয়নালকে হারিয়ে দেন। অন্যদিকে জয়নালের দুই বন্ধু উজিরকে মিথ্যা খবর দেয় যে, বাকের জয়নালকে হত্যা করে লাশ গুম করেছে। উজির ছেলের হত্যার বিচার চায়।নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁ পুত্র বাকেরকে বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন। অবশেষে বাকেরের হাতে মারা যায় বাঘ। ইতিমধ্যে জয়নালের মৃত্যুর মিথ্যা খবর ফাঁস হয়ে গেছে এবং সে জোর করে খনি বেগমকে ধরে নিয়ে যায় দক্ষিণ বঙ্গে। আর খনি বেগমকে উদ্ধার করতে যান বাকের । পিছু নেন উজির জাহান্দার খান। ছেলে জয়নাল খান বাকেরকে হত্যার চেস্টা করলে উজির নিজের ছেলেকে হত্যা করেন তলোয়ারের আঘাতে। সেই অবস্থাতে জয়নাল খনি বেগমকে তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করে। বাকেরগজ্ঞে সমাধিস্থ করা হয় খনি বেগমকে। আর বাকের সবকিছু ত্যাগ করে রয়ে গেলেন প্রিয়তমার সমাধির কাছে দক্ষিণ বঙ্গে। বাকের খাঁর নামানুসারেই বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ তথা পটুয়াখালি-বরিশাল অঞ্চলের নাম হয় বাকেরগঞ্জ। ঐতিহ্য্যবাহী বাকরখানি রুটির নামের পেছনেও রয়েছে বাকের এবং খনির এই প্রেমের ইতিহাস।অবশ্য নামকরণের ব্যাপারে অন্য আরেকটি তথ্য বা মতামত রয়েছে। সে অনুযায়ী মির্জা আগা বাকের ঢাকায় বাকরখানি রুটি প্রচলন করেন। তিনি বৃহত্তর বরিশালের জায়গীরদার ছিলেন। তার প্রেয়সী ছিল আরামবাগের নর্তকী খনি বেগম। তাদের মধ্যে গভীর প্রেম ছিল বলে কথিত আছে।

 

পরবর্তীতে আগা বাকের ২য় মুর্শিদ কুলি খাঁর কন্যাকে বিয়ে করেন। কিন্তু খনি বেগমের স্মৃতি তিনি ভুলে যাননি । তার আবিস্কৃত এবং প্রিয় খাদ্য বিশেষভাবে তৈরি রুটির নাম তার প্রেমকাহিনীর উপর ভিত্তি করেই নামকরণ করা হয়েছিল বাকের-খনি রুটি । পরবর্তীতে এই নাম কিছুটা অপভ্রংশ হয়ে বাকরখানি নাম ধারণ করে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে বাখরখানির সৃষ্টি আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়। অনেকে আবার ধারণা করেন যে সিলেট জেলায়ও নাকি সর্বপ্রথম বাকরখানি তৈরী হয়েছিল।বাকরখানির ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে মুগ্ধ হয়ে কবি প্রতুল মুখোপাধ্যায় তার কবিতায় লিখেছেন-

 

আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাকরখানি
বেচো না বেচো না বন্ধু তোমার চোখের মণি।
ঝিঙে বেচো পাঁচ সিকেতে হাজার টাকায় সোনা
হাতের কলম জনম দুঃখী তাকে বেচো না।
তবে বাকরখানি এখন পাওয়া যায় পুরান ঢাকার নারিন্দা, লোহারপুল, গেন্ডারিয়া, নাজিরাবাজারসহ বিভিন্ন অলি-গলিতে। পুরান ঢাকা ছাড়া অন্য কোথাও এখন বাকরখানির দোকান সচরাচর দেখা পাওয়া যায় না।বাকরখানির দোকানগুলায় দুই ধরনের বাকরখানি পাওয়া যায়। বর্তমানে পুরান ঢাকার কারিগররা ময়দা, তেল/ ডালডা, পানি ও তন্দুর ব্যবহার করে বাকরখানি তৈরি করে থাকেন। এজন্য প্রথমে সব উপকরণ মিশিয়ে খামির তৈরি করে নিতে হবে। এরপর সেখান থেকে ছোট ছোট কোয়া কেটে আলাদা করে নিতে হবে। এরপর বেলন দিয়ে বেলে গোলাকৃতির করে নিতে হবে। মাঝখান বরাবর ছুরি দিয়ে লম্বা তিনটি দাগ দিয়ে নিতে হবে। এরপর সামান্য পানির প্রলেপ দিয়ে তন্দুরের দেয়ালে আটকে দিতে হবে।

এরপর ৫ থেকে ৭/৮ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। এর ভেতরই তৈরি হয়ে যাবে সুস্বাদু বাকরখানি।বাকরখানির দোকানগুলায় দুই ধরনের বাকরখানি পাওয়া যায়। একটি মিষ্টি ধরনের, অপরটি মিষ্টি ছাড়া। প্রতি পিসের দাম ৫-১০ টাকা হয় এবং প্রতি কেজি ১২০-১৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। বর্তমানে বকরখানি আজ বহু মানুষের প্রিয় ও পুরাণ ঢাকার ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।
লেখক:

শিক্ষার্থী,

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

সর্বশেষপঠিত

এলাকার খবর

Developed By: Dotsilicon