মো: সবুজ হোসেন
ঢাকা বর্তমানে পৃথিবীর ১৩তম মেগা সিটি হিসেবে পরিচিত। মেগা সিটি হিসেবে বিবেচিত হয় এমন শহরগুলোর জনসংখ্যা ১০ মিলিয়ন (১ কোটি) বা তার বেশি। ঢাকায় বর্তমানে প্রায় ২ কোটি মানুষের বাস, এবং এটি দ্রুত বর্ধনশীল। এই বর্ধনশীল মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নানা সমস্যা। ফলে ধীরে ধীরে বসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।আর এইসব সমস্যার মধ্যে অন্যতম সমস্যা হলো বায়ুদূষণ। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই ) এর সূচকে ঢাকা সারা বছরেরই বায়ু দূষণে ১২৬ টি দেশের মধ্যে প্রথম সারিতেই অবস্থান করে। আর শুষ্ক মৌসুম অর্থাৎ শীতকাল(নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি) এলেই বায়ু দূষণ তীব্রতর আকার ধারণ করে। ৫ ডিসেম্বর ২০২৪ এ একিউআই এর সূচকে ঢাকার স্কোর দেখা যায় ৩৯২, যা ১২৬ টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ।।যখন বায়ু দূষণের একিউআই মান ৫০ থেকে ১০০ এর মধ্যে থাকে তখন বায়ুর গুণমানকে ‘মাঝারি’ বলে বিবেচনা করা হয়।
একিউআই সূচক ১০১ থেকে ১৫০ এর মধ্যে হলে ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ সময় সাধারণত সংবেদনশীল ব্যক্তিদের দীর্ঘ সময় ধরে বাইরে পরিশ্রম না করার পরামর্শ দেওয়া হয়। ১৫১ থেকে ২০০ এর মধ্যে হলে ‘অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে বিবেচিত হয়।
আর সূচক ২০১ থেকে ৩০০ এর মধ্যে হলে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ বলে মনে করা হয়।
এছাড়া ৩০১ এর বেশি হলে ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে বিবেচিত হয়, যা বাসিন্দাদের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।
বাংলাদেশে একিউআই সূচক পাঁচটি দূষণের ওপর নির্ভরশীল। সেগুলো হলো-বস্তুকণা (পিএম১০ ও পিএম২.৫), এনও২, সিও, এসও২ ও ওজোন। একিউআই সূচক এর মান যেখানে ৩০১ এর বেশি হলে তাকে বিপজ্জনক হিসেবে ধরা হয় সেখানে বাংলাদেশের বায়ুমান ৩৯২ অর্থাৎ পরিবেশ কতটুকু ভয়াবহ, এ থেকেই অনুমান করা যায়। ঢাকার বায়ু দূষণের জন্য যেসব কারণ দায়ী,, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো:রাজধানীতে যেসব যানবাহন চলাচল করে সেগুলোর অধিকাংশই মানসম্মত জ্বালানি ব্যবহার করে না। ফিটনেস নেই, নিম্নমানের লুব্রিকেন্ট ব্যবহার এবং এগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। এ ধরনের যানবাহন থেকে ক্ষতিকর কার্বন মনোক্সাইড, ডাইঅক্সাইড, সিসা, সালফার, কার্বন, ওজোন, নাইট্রোজেন অক্সাইড বের হয়ে বাতাসে মিশে যাচ্ছে। এসব যানবাহন বায়ুদূষণের জন্য প্রায় ৭০ শতাংশ দায়ী। এছাড়াও জনঘনত্ব বিবেচনায় ঢাকা শহরে এসব বিপজ্জনক ধাতু ও যৌগ পদার্থের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। এছাড়াও প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের সময় কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়াও বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। পাশাপাশি নির্মাণকাজ, রাস্তাঘাট সংস্কার ও খোঁড়াখুঁড়িকে অনেকে বায়ুদূষণের জন্য দায়ী করে থাকে। কিন্তু বাস্তবে নির্মাণসংশ্লিষ্ট কাজ, সড়ক সংস্কার ও খোঁড়াখুঁড়ির ফলে সৃষ্ট ধুলাবালির পরিমাণ ১০ শতাংশের মতো। বিশেষ করে শীতের শুষ্ক পরিবেশে ধুলাবালি বাতাসে বেশি ভেসে বেড়ায়। অবকাঠোমো নির্মাণযজ্ঞ থেকে বেরুনো ধুলাবালি, যানবাহনের ধোঁয়া এবং শিল্প কারখানার বর্জ্য মিলে এই দূষণ আরও বাড়িয়ে দেয়। শীতকালে কুয়াশার কারণে দূষিত কণা বাতাসে বেশি সময় ধরে মিশে থাকে। কুয়াশা নিজেও বায়ুদূষণের ক্ষতিকর কণাকে ধারণ করে বাতাসকে ভারী করে তোলে। বায়ুদূষণ অসংক্রামক রোগগুলোর অন্যতম কারণ। দূষিত বায়ু থেকে সাধারণত ফুসফুসজনিত রোগ হয়। এর মধ্যে অ্যাজমা, অ্যালার্জি, বমি, শ্বাসকষ্ট অন্যতম। মানসিক চাপ বা উচ্চরক্তচাপও অনেক সময়ে বায়ুদূষণ থেকে হতে পারে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণে ফুসফুসে সংক্রমণ, হৃদরোগ ও ফুসফুসের ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। ২৩ শতাংশ স্ট্রোক ও ৩২ শতাংশ হার্ট ফেইলরের কারণ বায়ুদূষণ। এলঝেইমার্স ও পারকিন্সন জিজিও হয় বায়ুদুষণের ফলে। শিশু, বয়স্ক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী।বায়ু দূষণের প্রতিকার করার জন্য প্রথমেই বায়ু দূষণের উৎস গুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। ঢাকার বায়ু দূষণের জন্য যানবাহনের কালো ধোঁয়া প্রধান কারণ,, তাই প্রথমেই ফিটনেসবিহীন অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে। বায়ু দূষণের দায়ী এমন কলকারখানায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে সেগুলোকে বন্ধ করতে হবে। পরিবেশবান্ধব যানবাহন ব্যবহার করা যেতে পারে। জীবাশ্ম জ্বালানি গ্যাস, কাঠ, কয়লার ব্যবহার কমাতে হবে। খোলা জায়গায় প্লাস্টিক বা অন্যান্য বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ করতে হবে। একটি সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। অধিক সংখ্যক মানুষকে গণ পরিবহন ব্যবহার করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ব্যক্তিগত পরিবহন যতটা সম্ভব পরিহার করতে হবে।কলকারখানা গুলোতে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বসানো বাধ্যতামূলক করতে হবে।নবায়ন যোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে।যানযট কমাতে কার্যকর শহর পরিকল্পনা এবং সবুজ অঞ্চল তৈরি করার উদ্যোগ নিতে হবে। বায়ু দূষণ রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং এর সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে। । এছাড়া জনগণকে সচেতন করতে হবে যাতে তারা রাস্তায় বের হলে মাস্ক পরিধান করে। সর্বোপরি সরকার এবং জনগণকে যৌথভাবে এগিয়ে আসতে হবে এই সমস্যা দূর করার জন্য।
লেখক : শিক্ষার্থী, গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য