মাহফুজ রাজা,ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি:
প্রেম স্বর্গীয় আভা যার উৎপত্তিস্থল স্বর্গে, লাইলী মজনু,ইউসুফ -জুলেখা, শিরি-ফরহাদ,রোমিও-জুলিয়েট,মেহবুব-দিলরুবা,শাহজাহান -মমতাজ কিংবা নচিকিতা-নীলাঞ্জনা,মনির খান-অঞ্জনা ইত্যাদি মানব প্রেমের বহু ইতিহাস ভূবনময় রটিত আছে,কারো প্রেম কাব্যে কারো প্রেম গানে বা গদ্যে কারো প্রেম বাস্তবতায়।এমন জীবন্ত বাস্তব প্রেম মানব-মানবী প্রেমের ইতিহাসগুলি প্রতিটা রোমাঞ্চিত মনে নাড়া দেয়।ক্ষনিকের জন্য হলেও হৃদয় সঙ্গ দিতে চায় এমন মধুময় ও হিমালয় সমেদ বাঁধা অতিক্রম করে দুটি মন মিলিত হবার স্বপ্নে কিন্তু যদিওবা নারী-পুরুষের প্রেমের শেষ পরিনতি বিয়ে তবুও সব প্রেমই পূর্ণতা পায়না।আর সাম্প্রতিক কালের প্রেমতু
খেলা মাত্র, শরিরি খায়েশ মিটানো। তবে আগেকার ইতিহাসিক এমনো প্রেমের গল্প জনস্রোতি আছে যা পৃথিবী জয় করার চেয়েও কঠিন পরিস্থিতির মাঝে মনে ভালোবাসা জাগ্রত রেখেছে প্রেমিক-প্রেমিকারা।একটা বিষয় আমরা হয়তো সকলেই অবগত পৃথিবীর যত সত্য বিপদগামী হয়েছে বিভিন্ন দুষ্ট লোকের প্ররোচনা কিংবা ষড়যন্ত্রে।
তবে এটা সাময়িক, যেখানে সত্য মলিন রুপ ধারণ করেছে সেখানেই কিন্তু স্মরণীয় ইতিহাসের জন্ম হয়েছে এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সতর্কতা রেখে গেছে।বীরাঙ্গনা সখিনার সমাধি এমনই এক স্বাক্ষী বহন করে।
ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার মাওহা ইউনিয়নের কেল্লা তাজপুর গ্রামের কুমড়ী নামক স্থানে সতের শতকের মুঘল সম্রাজ্যের স্মৃতিবহন করছে বীরাঙ্গনা সখিনার সমাধি। এক নারীর অপ্রতিরোধ্য প্রেমের নিরব সাক্ষ্য দেয় এই সমাধি।
সখিনার সমাধিটি গৌরীপুর থেকে ১৪/১৫ কিলোমিটার দূরত্বে। সরেজমিনে গেলে প্রথমেই চোখে পড়বে একটি গেটসম্বলিত সীমানা প্রাচীর। প্রধান ফটকের সীমানা প্রাচীরে পাথরখণ্ডে লেখা আছে বীরাঙ্গনা সখিনার কাহিনি।
জানা যায়, কেল্লা তাজপুরের মুঘল দেওয়ান উমর খাঁর সুকন্যা ছিলেন সখিনা। একদিকে তিনি ছিলেন অপরূপ সুন্দরী, অন্যদিকে সর্ববিদ্যায় পারদর্শী। তার রূপ-গুণের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল বহুদূর পর্যন্ত।
৫০ থেকে ৬০ মাইল দূরবর্তী বারভূঁইয়ার অন্যতম কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ির স্বাধীন শাসক ঈশা খাঁর নাতি ফিরোজ খাঁ সখিনার রূপ ও গুনের বর্ণনা শুনে তাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। সে সময় দেওয়ান উমর খাঁ পরিবারের কঠোর পর্দাপ্রথা চালু থাকায় সখিনাকে দেখার সুযোগ ছিল না।
ফিরোজ খাঁ দরিয়া নামের এক নারীকে তসবি বিক্রেতা সাজিয়ে উমর খাঁর অন্তঃপুর তথা সখিনার বাসগৃহে পাঠান। দরিয়ার মুখে ফিরোজ খাঁর অসামান্য রূপ-গুণের কথা শুনে সদ্য যৌবন প্রাপ্ত সখিনাও তাকে ভালোবেসে ফেলেন। ফিরোজ খাঁ উমর খাঁর দরবারে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু কন্যাপক্ষ সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। লজ্জা ও ক্ষোভে ফিরোজ খাঁ বিশাল বাহিনী নিয়ে কেল্লা তাজপুরে অভিযান চালান। অতর্কিত আক্রমণে উমর খাঁর বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পরাজয় বরণ করে। তখন ফিরোজ সখিনাকে নিজের কাছে নিয়ে যান এবং বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করেন।
কিন্তু উমর খাঁ এই বিয়ে মেনে নিতে পারেননি।
পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে ফিরোজ খাঁ-কে বন্দী করেন। তার সৈন্যবাহিনী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। সে সময় পুরুষবেশে যুদ্ধে অংশ নেন সখিনা। স্বামীর পক্ষে বাবার বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধ। সখিনার অংশগ্রহণে উমর খাঁর বাহিনী বিপন্নপ্রায় হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি পাল্টে যায় উমর খাঁর জনৈক উজিরের কুমন্ত্রণায়। গুজব রটিয়ে দেওয়া হয় ফিরোজ খাঁ তার স্ত্রী সখিনাকে তালাক দিয়েছেন। এ খবর সখিনার কানে পৌঁছালে তিনি ভেঙে পড়েন। যুদ্ধ কৌশল সঠিকভাবে পরিচালনার শক্তি হারান। একসময় বিপক্ষ শক্তির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। শিরোস্ত্রাণ খুলে গেলে দেখা যায় বীর সখিনার মুখ। উমর খাঁ কন্যাকে হারিয়ে শোকে পাগল প্রায়। এরপর ফিরোজ খাঁকে বন্দীশালা থেকে মুক্তি দেন।
জনশ্রুতি আছে, এরপর থেকে প্রতি সন্ধ্যায় দরবেশধারী ফিরোজ খাঁ প্রদীপ জ্বেলে সখিনার সমাধির পাশে নিশ্চুপে বসে থাকতেন। তিনি আমৃত্যু সখিনাকে না পাওয়ার বেদনায় কাতর ছিলেন। এই প্রেম ইতিহাসে অমর। এই গল্প একদিকে বীরত্বের অন্যদিকে এক বিয়োগের।
সখিনার সমাধিটি গিলাফ দিয়ে ঢাকা। উপরে একটি ছাউনি আছে। সবথেকে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য হলো সমাধিটি ঘিরে রেখেছে অনেক কাঠ গোলাপের গাছ। গাছগুলো দেখে মনে হলো বীরাঙ্গনা সখিনার শৌর্য, বীর্যের প্রতীক। আবার মনে হলো গাছগুলো বড় মায়ায় সমাধিটি ঘিরে রেখেছে। যেন কন্যার প্রতি মাতৃমমতার ছায়া। ডালপালাগুলো কোথাও কোথাও শূন্যের দিকে উঠে গেছে আবার মাটির সঙ্গে মিশে আছে।
বীরাঙ্গনা সখিনা একদিকে ছিলেন কোমল মনের অধিকারী অন্যদিকে যোদ্ধা। সখিনার জীবন যেন নারীপ্রেমের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
মন্তব্য