জাবি প্রতিনিধি
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমীকরণ মেলাতে গেলে দেখা যাবে এখনো পর্যন্ত প্রাপ্তির খাতার একটা বড় অংশ ফাঁকা। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) শাখা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের দুরবস্থা কাটিয়ে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন, তারা কি পারবে জুলাইয়ের প্রত্যাশা পূরণ করতে? সহাবস্থান নাকি উভয় পক্ষের অসহিষ্ণু মনোভাবের ফলে সন্ত্রাস?
শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ করে সর্বসম্মত কিছু প্রত্যাশা পাওয়া গেছে। তা হলো, রাজনৈতিক সহাবস্থান নিশ্চিত, জুলাইয়ের চেতনাকে ধারন করে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি পরিহার ও শিক্ষার্থীবান্ধব রাজনীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। এছাড়াও তারা চান , অতীতের ন্যায় টেন্ডারবাজি , চাঁদাবাজি, হলের সীট-বাণিজ্য, সীট দখল, গণরুম-গেস্টরুমের অপসংস্কৃতি, মাদক ব্যবসা, নারী নির্যাতন সহ সকল অপকর্মের মূল হোতারা যেন ছাত্ররাজনীতির ছত্রছায়ায় না থাকে।
দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক সহাবস্থান নিশ্চিত না হলে শিক্ষাঙ্গন সন্ত্রাসবাদের আখড়া হয়ে যাবে। অতীতে আমরা অসহিষ্ণু রাজনীতির ভয়াল রুপের কড়াল গ্রাস ও সন্ত্রাসবাদের আস্ফালন দেখেছি। দলীয় এজেন্ডাকে শিক্ষার্থীদের নামে চালিয়ে দিয়ে ফায়দা লুটার অপতৎপরতাও আমরা দেখেছি। আর এসব চাইনা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা চাই ছাত্রসংগঠনগুলো জুলাইয়ের ২ হাজার শহিদ ও হাজার হাজার আহতের কথা স্মরণ রাখেন৷ তাদের রক্তের সাথে বেইমানি যেন না করা হয়। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৯ দফায় ছিল, ছাত্রসংসদ কার্যকর করতে হবে। সেটির বাস্তবায়ন কোথায়? নাকি আবারও পেশি শক্তির মাধ্যমে জোর যার মুল্লুক তার নীতিতে সবাই চলতে চায়?
আবু সায়েম বলেন, আমরা অতীতে দেখেছি বাম সংগঠনগুলোর একাংশ ছাত্রলীগের সাথে আঁতাত করে চলেছে। এমনকি জুলাই আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত অথবা ব্যর্থ করার জন্যও অপচেষ্টা চালিয়েছে। ছাত্রলীগ বিদায় হলেও তাদের দোসররা বেনামে বিভিন্ন যায়গায় প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে। আমরা চাই, আগামীর রাজনীতি পরগাছা ও দালালমুক্ত থাকুক। আগামী দিনে দলীয় স্বার্থে সংকীর্ণ মানসিকতার পরিচয় না দিয়ে সকলেই সহাবস্থান নিশ্চিত করুক। জুলাইয়ে ঐক্য গড়তে পারলে এখনো ঐক্য সম্ভব। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছার।
এছাড়াও শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির শেকল থেকে এখনো আমরা পুরোপুরি বের হতে পারিনি তার অন্যতম প্রমান, ছাত্রসংসদ নির্বাচন এতদিন বিলম্বিত হওয়া। অনেকেই নিজেদের আধিপত্য বিস্তার ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থবিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য ছাত্রসংসদ চায় না।
গণঅভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক আব্দুর রশিদ জিতু বলেন, ২৪ এর ছাত্র জনতার গনঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের প্রতিটি সেক্টরেই পরিবর্তন হওয়ার পথে। তারই ধারাবাহিকতায় দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনৈতিক চর্চার পদ্ধতিও পরিবর্তন হওয়াটা জরুরি। সেই আগের মতোই শোডাউন ও ভাই পলিটিক্স নির্ভর রাজনীতি থেকে বের হয়ে জ্ঞান ও গবেষণামূলক রাজনীতি চর্চার সংস্কৃতি চালু করতে হবে। আমরা মনে করি বিশ্ববিদ্যালয় গণতন্ত্র চর্চার একটি উন্মুক্ত স্থান। সে জন্য প্রত্যেকটি ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনের সহাবস্থান জরুরি।কোন ছাত্র সংগঠনের একক আধিপত্য কায়েম রোধে প্রশাসনকে সচেষ্ট থাকতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান ছাত্রদের মধ্যে থেকে কমিটি দিতে হবে। বিভাগের ছাত্রসংসদ গুলো কার্যকর রাখার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদগুলো নির্বাচনের ধারাবাহিকতাও বজায় রাখতে হবে। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা অধ্যাদেশের মাধ্যমে ছাত্রসংগঠনগুলোকে একটি বিধির মধ্যে আনতে হবে।
জাবি শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন মোহম্মদ বাবর বলেন, জুলাই গনঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক ধারা তৈরি হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল একবিংশ শতকের সময়োপযোগী ছাত্ররাজনীতি বিনির্মাণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি হলের সিট দখল , টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির রাজনীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সেন্টিমেন্ট কে ধারণ করে নতুন ধারার ইতিবাচক রাজনীতি অব্যহত রাখবে। আমরা সবসময় সকল ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি, কিন্তু যারা নিজেদের পরিচয় গোপন করে গুপ্ত রাজনীতি করে তাদের বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নিবে।
এছাড়াও তিনি বলেন, আমরা সবসময় ছাত্র সংসদ কার্যকর রাখার পক্ষে। সকল ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রশাসন জাকসু নির্বাচন বিষয়ক একটি সাধারণ সভা করেছিলেন। সেখানে নির্বাচনের পূর্বে অনেকগুলো সংস্কারের দাবী আসে। প্রতিটা সংস্কার নিয়ে একেকটা কমিটি করা হয়। কমিটির রিপোর্টের পর সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকল কমিটির রিপোর্ট প্রদানের পর সংস্কার করে নির্বাচনী তফসিল দিতে হবে।
সরকার ও রাজনীতি ৫০ ব্যাচের শিক্ষার্থী আয়ান বলেন, রাজনৈতিক সহাবস্থান নিশ্চিত না হলে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব নয়। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধ ও ছাত্রসংসদ কার্যকরের জন্য ৫ হাজার শিক্ষার্থীর স্বাক্ষর সংগ্রহ করলেও আক্ষরিক অর্থে কিছুই করতে পারেনি। প্রশাসনের অনেকের অনিচ্ছা ও অসহযোগিতার কারনে ছাত্রসংসদ এখনো কার্যকর হয়নি। জাকসু কার্যকর হলে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশার প্রতিফলন হবে, এতে কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের অপকর্মের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। সেজন্য তারা জাকসু চান না। জাকসুর বিষয়ে প্রশাসন একেবারেই বৈরী। বিভিন্ন যায়গা থেকে জাকসু’র গঠনতন্ত্রের সংস্কার চাওয়া হচ্ছে। জাকসু’র সংস্কারের জনও ছাত্রসংসদ প্রয়োজন বলে আইনে উল্লেখ আছে। আমরা চাই জুলাইয়ের শহিদদের কথা স্মরনে তারা জাকসু নির্বাচন দেন।
জাহাঙ্গীরনগর সংস্কার আন্দোলনের আহ্বায়ক ইয়াহিয়া জিসান বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে যে বিরূপ ধারণা তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে ইতিবাচক ও সুষ্ঠু পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন। ছাত্ররাজনীতিকে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষার একটি মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সহাবস্থানের রাজনীতি নিশ্চিত করতে হবে। ছাত্ররাজনীতির ‘ছাত্রলীগ মডেল’ থেকে দূরে সরে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ বা কল্যাণকে প্রাধান্য দিতে হবে। প্রশাসনের উচিত নিরপেক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ নয় এমন সকল ছাত্রসংগঠনকে প্রকাশ্য ছাত্ররাজনীতি চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। লেজুড়বৃত্তিমুক্ত ছাত্ররাজনীতি এবং সহাবস্থানের রাজনীতি নতুন বাংলাদেশে অতীব জরুরি।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এবং সমাজের বিভিন্ন অংশের সহযোগিতায় ছাত্ররাজনীতির জন্য একটি সুস্পষ্ট গাইডলাইন তৈরি করা প্রয়োজন। প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিবাচক রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়াতে কর্মশালা, সেমিনার ও আলোচনা সভার আয়োজন করতে হবে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে নৈতিকতা ও নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি।
জাবি শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি অমর্ত্য রায় বলেন, ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে ২৪’র ছাত্রবিদ্রোহ পর্যন্ত সবকিছুতেই ছাত্রদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সুষ্ঠু ধারার রাজনীতির বন্দোবস্ত করতে হলে জাকসু’র কার্যকারিতা প্রয়োজন। এটা শুধু বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নয় বরং সকল ছাত্রসংগঠনের দাবী। জাকসু নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল ছাত্ররাজনীতির গুণগত পরিবর্তন করা সম্ভব। ছাত্রসংসদ না থাকার কারনেই ছাত্ররাজনীতি বিভিন্নভাবে কলুষিত হয়েছে। আমরা আর আগের মত মাফিয়াতন্ত্র, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের পুনরাবৃত্তি চাইনা। সহাবস্থানের প্রশ্নে তিনি বলেন, একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আমরা চাই তারা তাদের অতীত কর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে রাজনীতিতে আসুক। তিনি আরও বলেন, আমরা বিগত সময়ে দেখেছি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ও প্রশাসনের গোপনচুক্তির মাধ্যের ছাত্রসংসদগুলো বন্ধ ছিল। তারা এখনো চায়না ছাত্রসংসদ কার্যকর হউক। আমরা চাই, দীর্ঘ প্রায় ৩২ বছরের বিরাজনীতিকরনের এই প্রক্রিয়া বন্ধ হউক।
জাবি শিবির সভাপতি মহিবুর রহমান মুহিব বলেন, বিগত প্রায় দেড়-যুগ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্রশিবির সহ সকল স্বৈরাচার বিরোধী সংগঠন রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিত ছিল৷ এখন সময় এসেছে গুনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন ধারার রাজনীতি চালু করার। ছাত্রশিবির তার জন্মলগ্ন থেকেই ইতিবাচক ধারার রাজনীতি করে আসছে। আমাদের দীর্ঘ পথচলায় কোন নেতার বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, নারী কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি, মাদক ইত্যাদি অপকর্মের কোন অভিযোগও নেই। আমরা চাই পেশি শক্তির পরিবর্তে বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির চর্চা হউক। ছাত্ররাজনীতি যেন টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ, হলের অবৈধ বাসিন্দা, মাদকাসক্ত ও মাদক ব্যবসায়ীদের অভয়ারণ্যে পরিনত না হয়। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে। সকল প্রকার লেজুড়বৃত্তিক-ছাত্ররাজনীতি মুক্ত একটি ক্যাম্পাস গড়তে ক্রিয়াশীল সকল সংগঠন শিক্ষার্থীদের অধিকার, দাবী-দাওয়া, প্রত্যাশা ও স্বার্থের প্রতি সম্মান-সংহতি জানিয়ে স্ব স্ব অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। অতীতের ন্যায় আবারও যেন গনরুম, গেস্টরুম, ট্যাগিংয়ের অপসংস্কৃতি চালু না হয় সেক্ষেত্রে সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। একই সাথে ছাত্রসংসদ কার্যকর করা অতীব জরুরি।
মন্তব্য