শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪
 

দেশে জ্বালানী তেল মজুদের পর্যাপ্ত সক্ষমতার অভাবে আপদকালীন সময়ে বিপদের শঙ্কা

JK0007
প্রকাশ: ৪ আগস্ট ২০২২

ফাইল ছবি

দেশে জ্বালানী তেল মজুদের পর্যাপ্ত সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। ফলে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানী তেলের দাম বেড়ে গেলে বিপিসির লোকসানের বোঝা ভারি হয়ে ওঠে। আর কম দামের সময় মজুদ সক্ষমতার অভাবে পরিস্থিতির সুযোগ নেয়া সম্ভব হয় না। বরং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে (বিপিসি) প্রতিনিয়ত জ্বালানী তেল আমদানি করতে হয়। বর্তমানে দেশে জ্বালানী তেলের মজুদ সক্ষমতা প্রায় ১৩ লাখ টন। ওই পরিমাণ জ্বালানী তেল দিয়ে ৪০-৪৫ দিনের মতো চাহিদা মেটানো সম্ভব। তার মধ্যে অর্ধেকই বিপিসির অধীন বিতরণ কোম্পানিগুলোর বিপণনের উদ্দেশ্যে জমাকৃত। সেখানে কৌশলগতভাবে সংরক্ষণের সুযোগ কম।  এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজনের মুহূর্তে জ্বালানী তেলের কৌশলগত মজুদের অভাব বড় ধরনের বিপদের কারণ হয়ে উঠার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশে জ্বালানী তেলের কৌশলগত মজুদ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে কোনো বিনিয়োগ হয়নি। বর্তমানে দেশে তেল মজুদের যতোটুকু সক্ষমতা রয়েছে তা মূলত বিতরণগত বা বিপণনের উদ্দেশ্যে গড়ে তোলা। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম ক্রমাগত বেড়ে চলায় নিয়মিত লোকসানে থাকা প্রতিষ্ঠান বিপিসির আর্থিক চাপ বাড়ছে। পরিস্থিতিকে আরো প্রকট করে তুলছে জ্বালানী তেল আমদানিতে ডলার সঙ্কটে এলসি জটিলতা। অথচ দেশে জ্বালানী তেলের পর্যাপ্ত মজুদের ব্যবস্থা থাকলে এমন পরিস্থিতিতে বিপিসি আর্থিক চাপ থেকে কিছুটা রেহাই পেতো। স্বাভাবিক অবস্থায় আমদানিনির্ভর দেশগুলোর আপতকালীন ব্যবহারের জন্য অন্ত ৯০ দিনের জ্বালানী তেলের সংস্থান রাখা প্রয়োজন। কিন্তু এদেশে জ্বালানী তেলের মোট মজুদ সক্ষমতা তার অর্ধেক। আর বিপিসির তথ্যানুযায়ী জ্বালানী তেলের এখনকার যে মজুদ আছে তা দিয়ে আরো ৩২ দিন চালানো সম্ভব। এমন অবস্থায় বিশ্ববাজারের মূল্য পরিস্থিতির পাশাপাশি আমদানি এলসি জটিলতাও বড় আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছে। কৌশলগত মজুদ সক্ষমতা গড়ে তোলা গেলে বাংলাদেশ এমন পরিস্থিতি খুব সহজেই মোকাবেলা করতে পারতো।

সূত্র জানায়, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিশ্বের অনেক দেশই বিনিয়োগের মাধ্যমে জ্বালানী তেলের কৌশলগত মজুদ সক্ষমতা বাড়িয়ে তুলছে। যুদ্ধ বা দুর্যোগকালীন বিপদের সময়ে সরবরাহ ঠিক রাখা এবং বাজার অস্থিতিশীলতার সময়ে জ্বালানী পণ্যের ক্রমাগত দর বৃদ্ধির চাপ থেকে জনগণকে সুরক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যেই মূলত ওই সক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা হয়। তাছাড়া পণ্যটির বাজার বা আন্তর্জাতিক পরিম-লের নানামুখী ঘটনাবলি যাতে দেশের জ্বালানী ব্যবস্থাপনাকে নাজুক করে তুলতে না পারে সেজন্যও মজুদ সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ তেমন একটা নেই বললেই চলে। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে নির্মিত দেশের একমাত্র জ্বালানী তেল পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি ছাড়া মজুদের জন্য আর কোনো বড় অবকাঠামোও গড়ে ওঠেনি। অন্য যেগুলো রয়েছে সেগুলোর সক্ষমতাও যৎসামান্য। বিপিসির মজুদকৃত জ্বালানী তেল সংশ্লিষ্ট বিপণনকারী সংস্থার প্রধান, মাঝারি ও ছোট ডিপোগুলোয় সংরক্ষণ করা হয়। আর ওই সক্ষমতার বড় একটি অংশই বন্দরনগরী চট্টগ্রামে রয়েছে। তাছাড়া বাগেরহাটের মোংলা, নারায়ণগঞ্জ, দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ডিপোয় বাকি সক্ষমতা রয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিচালনাধীন দেশের বৃহত্তম জ্বালানী তেল মজুদাগারের সক্ষমতা ৫ লাখ ২ হাজার ২৯০ টন। তার বাইরে জ্বালানী তেল বিপণনকারী সংস্থা পদ্মা ও যমুনা অয়েল এবং মেঘনা পেট্রোলিয়ামের আওতাধীন ডিপোগুলোর মোট মজুদ সক্ষমতা প্রায় ৮ লাখ টন। তার মধ্যে পদ্মা অয়েলের চট্টগ্রামের প্রধান ডিপোয় মজুদ সক্ষমতা রয়েছে ১ লাখ ৪১ হাজার ৫৭৩ টন। আর বাগেরহাটের মোংলায় ৩৫ হাজার টন ও নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে ৩০ হাজার ৯৩৪ টন সক্ষমতার মজুদাগার রয়েছে। যমুনা অয়েলের চট্টগ্রামের প্রধান ডিপোয় ৮২ হাজার ২৪০ টন এবং মোংলায় ২৯ হাজার ৬৩০ টন সক্ষমতার মজুদাগার রয়েছে। মেঘনা পেট্রোলিয়ামের চট্টগ্রামের প্রধান ডিপোয় ১ লাখ ১৭ হাজার ৯৭৪ টন এবং মোংলায় ২৭ হাজার ৯৭২ টন সক্ষমতার মজুদাগার রয়েছে। তাছাড়া তার বাইরে বিপিসির অধীন স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল লিমিটেডের (এসএওসিএল) ৩৩ হাজার ৬২৫ টন সক্ষমতার মজুদাগার রয়েছে। অবশ্য ছোট ছোট আরো কিছু ডিপোয় নানা সক্ষমতার মজুদাগার গড়ে তোলা হয়েছে। সব মিলিয়ে ওসব মজুদাগারে সংরক্ষিত জ্বালানী তেল দিয়ে প্রায় দেড় মাসের মতো চাহিদা পূরণ সম্ভব।

এদিকে ক্রমাগত লোকসানে থাকা বিপিসির পক্ষে এখন উন্নয়নমুখী প্রকল্প হাতে নেয়াই মুশকিল হয়ে উঠেছে। ফলে এ মুহূর্তে জ্বালানী তেলের আমদানি ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনা চালু রাখাকে কেন্দ্র করেই সংস্থাটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। তবে সেগুলোর গতিও এখন ধীর হয়ে এসেছে। জ্বালানী তেল আমদানিতে অব্যাহত লোকসান, এলসি জটিলতা ও আর্থিক সংকট ব্যাপক জটিলতার কারণ হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে উদ্বৃত্ত মোটা অংকের টাকা সরকারকে দিয়ে দেয়ায় বিপিসির আর্থিক সক্ষমতাও চাপে পড়েছে। ফলে উন্নয়নমুখী প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে দেশের জ্বালানী তেল আমদানি ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখাতেই বিপিসি এখন বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।

অন্যদিকে জ্বালানী বিশেষজ্ঞদের মতে, আমদানিনির্ভর দেশ হিসেবে বাংলাদেশে জ্বালানী তেলের কৌশলগত মজুদ অবকাঠামো শক্তিশালী করা প্রয়োজন। বিশেষ করে বাজার অস্থিরতা বা সরবরাহ সংকটের মতো পরিস্থিতিতে ওই মজুদ সক্ষমতার অভাবটি বেশ ভালোভাবেই প্রকট হয়ে ওঠে। বৈশ্বিক মজুদ সক্ষমতার স্ট্যান্ডার্ড লেভেল ধরতে গেলে অন্তত দুই মাসের জ্বালানী  মজুদ রাখা প্রয়োজন। সেখানে বাংলাদেশের মাত্র দেড় মাসের মজুদ সক্ষমতা রয়েছে। আরো অন্তত ১৫ দিনের মজুদ সক্ষমতার মতো অবকাঠামো দরকার ছিল। কিন্তু তা গড়ে তুলতে ওঠেনি। দেশে জ্বালানী পণ্য মজুদে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন। সেটিও একটি সংকট।

এ বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ জানান, জ্বালানী তেল মজুদ ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নে অনেকগুলো প্রকল্প চলমান রয়েছে। ওসব প্রকল্পের অনেকগুলো বিপিসির নিজস্ব অর্থায়নে করা হচ্ছে। এমন অবস্থার মধ্যে বৈশ্বিক জ্বালানী তেলের বাজারদর বাড়তির দিকে থাকায় বিপিসির অব্যাহত লোকসান প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রভাব ফেলবে। তবে চেষ্টা করা হচ্ছে সব জটিলতা কাটিয়ে ওসব প্রকল্প যাতে দ্রুত চালু করা যায়। প্রকল্পগুলো বিপিসির জ্বালানী তেল আমদানি ও সরবরাহে ব্যাপক হারে ব্যয় সাশ্রয় করবে।

মন্তব্য

সর্বশেষপঠিত

এলাকার খবর

Developed By: Dotsilicon