ইলিশের ভরা মৌসুমে অনেক আশা নিয়ে সমুদ্রে গেলেও জেলেরা পর্যাপ্ত মাছ পাচ্ছেন না। সাগর চষে ইতোমধ্যে কয়েকটি নৌকা ট্রলার নিয়ে ঘাটে ফিরে এসেছে শূন্য হাতে। দেশে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার মেঘনা- নদীর জেলেরা হতাশ। চিন্তা বিকল্প কর্মসংস্থানের নদীতে ইলিশের আকাল, দাদনদার, মহাজনদের, বিভিন্ন এনজিওর ঋনের চাপ, এর উপর নতুন করে যুক্ত হয়েছে তেলের মূল্যবৃদ্ধি। দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তাদের জীবন। এমন দাবী মেঘনা-জেলে পাড়ার দাদনদার, আড়ৎদার ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের। তজুমদ্দিন উপজেলার জেলে পাড়ার প্রায় ৩ হাজার জেলে। আশানুরূপ ইলিশ না পেয়ে বাড়ছে ঋণের বোঝা। ফলে জেলেরা হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। অপরদিকে নতুন করে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে ব্যয়।
উপজেলা মৎস্য অফিস সুত্রে জানা গেছে, তজুমদ্দিন উপজেলার ৫ ইউনিয়নে নিবন্ধনভুক্ত ১৮ হাজার ৫’শ ১২ জন জেলে রয়েছে। শম্ভুপুর ইউনিয়ন ১ হাজার ৯’শ ৭৩, চাঁদপুর ইউনিয়ন ৭ হাজার ৩’শ ২২, সোনাপুর ইউনিয়ন ৪ হাজার ৮’শ ৭০, চাঁচড়া ইউনিয়ন ২ হাজার ৩’শ ৬৯, বড় মলংচঁড়া ইউনিয়ন ১ হাজার ৯’শ ৭৮,এদের আয়ের অন্যতম উৎস্য হলো নদীতে মাছ ধরা। যাদের জীবিকার মূল উৎস হলো মৎস্য আহরণ। জানা গেছে, ইলিশ মৌসুমে এলে জেলেরা বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে জাল ও নৌকা কিনে থাকেন। পরে ইলিশ মাছ আহরণ করে ঋণের টাকা পরিশোধ করেন। অপর দিকে নতুন করে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তজুমদ্দিনের জেলেরা পড়েছে বিপাকে।
সরেজমিনে উপজেলার চৌমুহনী, সুইচঘাট, ঘুরিন্দা বাজার, কাটাখালি, এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, দলবদ্ধভাবে নদীতে ইলিশ ধরতে গিয়েও খালি হাতে ফিরছেন অনেক জেলেরা। আর যে পরিমাণ মাছ পাচ্ছে তা দিয়ে তাদের নৌকার জ্বালানি খরচ ও শ্রমিকদের মজুরি মেটাতে পারছেনা তারা। এছাড়া ইলিশের আমদানি কম থাকায় বর্তমানে এক কেজি সাইজের ইলিশ প্রতি কেজি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রামের ইলিশ প্রতি কেজি এক হাজার ৮০০ টাকা আর ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকায়। জেলেদের অভিযোগ বাংলাদেশে ৬৫ দিনের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন ভারতীয় জেলেরা এসে ইলিশ ধরে নিয়ে গেছে। এছাড়া উপযুক্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় জালে ইলিশ ধরা পড়ছে না।
চৌমুহনীর নিরব মাঝি জানান, আগে তেল কিনতাম ৮০ থেকে ৮৬ টাকা করে।নতুন দামে ৭লিটার তেল ৭৯৮ টাকায় কিনে ৫ জন মাঝি মাল্লা নিয়ে নদীতে যাই। মাছ পাইছি মাত্র ১১’শ টাকার কিন্তু ইলিশ ধরা না পড়ায় এখন ঋণের টাকা কিভাবে পরিশোধ করবো তা নিয়ে চিন্তা আছি । জসিম নামে একজন জানান, যে পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ছে তা দিয়ে নৌকার জ্বালানি তেলের খরচ উঠছে না। এছাড়া সরকার নতুন করে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করায় দুর্ভোগ আরো বেড়েছে।
তজুমদ্দিন সুইচঘাট এলাকার জেলে আকতার মাঝি বলেন,আমরা ছয়জন জেলে রাত ৩টার দিকে নদীতে গেছি। আজ দুপুর পর্যন্ত মাত্র ৬টি ইলিশ পাইছি। একে তো নদীতে তেমন মাছ নেই। তার উপর তেলের দাম দিনদিন এভাবে বাড়লে আমরা কীভাবে নদীতে যাবো? দিন দিন লোকসান গুনতে গুনতে কিছুদিন পর আমাদের ট্রলার বিক্রি করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।আলম মাঝি বলেন, তেলের দাম বাড়ার কারণে বরফের দামসহ খরচের পরিমান বাড়ছে। সব মিলিয়ে কুল কিনারা করতে পারি না।
এক হাজার টাকার তেল নিয়ে দিনভর নদীতে জাল পেলে মাছ পেয়েছি মাত্র চারটি। এগুলো ঘাটে নিয়া বিক্রি কইরা ১২’শ টাকা পাইছি। ভাবছি দুই মাসের এনজিওর কিস্তি, আড়তদার ও মুদি দোকানের দেনা পরিশোধ করমু। কিন্তু নদীতে যাইয়া ট্রলারের তেলের টাকা উঠাতেও অনেক কষ্ট হচ্ছে।
এদিকে নদীতে পর্যাপ্ত ইলিশ না পাওয়ায় শঙ্কা প্রকাশ করেছেন মৎস্য পেশার সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরাও। কাটাখালির মৎস্য ঘাটের মৎস্য ব্যবসায়ী মো : আলম মিয়া, জাহাঙ্গীর মাঝি জানান, মাজারি একটি বোট সাগরে যেতে ৫ ব্যারেল(১০০০ লিটার) আর বড় বোটে ১০ ব্যারেল তেল লাগে। নতুন করে তেলের দাম বাড়ায় তারা লোকসানের মুখে পড়েছেন। দিনদিন জেলেদের উপর ঋণের বোঝা ভারী হওয়ায় অনেক জেলে মাছ শিকার থেকে মুখ ফিরিয়ে বিকল্প পেশা খুঁজছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন অনেকে।
তজুমদ্দিন উপজেলা মৎস্য আড়ৎদার সমিতির সভাপতি মো : হাসেম মহাজন বলেন, একদিকে নদীতে মাছ কম। অন্যদিকে, একলাফে তেলের দাম ১১৪ টাকা হয়েছে। এটা জেলেদের জন্য মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। বর্তমানে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় জেলেরা কিছুটা হলেও সমস্যায় পড়েছেন।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমির হোসেন জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে ইলিশ ধরা পরছে কিন্তু তজুমদ্দিন কেন ইলিশ মাছ ধরা না সেটি বুঝতে পারছি না। বৃষ্টি হলে নদীতে মাছের পরিমান বাড়বে। বর্তমানে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় জেলেরা কিছুটা হলেও সমস্যায় পড়েছেন। এটা বেশি দিন থাকবে না। তবে আগামী পূর্ণিমাতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়তে পারে।
তামিম সাদী মান্নান, ভোলা
মন্তব্য