গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানা এলাকায় ভূল চিকিৎসায় এক প্রসূতি নারীর মৃত্যুর চাঞ্চল্যকর ঘটনায় “জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়গনস্টিক সেন্টার” নামীয় বেসরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বন্যা আক্তারসহ মোট ০৬ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব ।
★★এবি পজেটিভ রক্তের পরিবর্তে বি পজেটিভ রক্ত পুশ
★★ভুল চিকিৎসার প্রসুতির মৃত্যু
★★নাসিং কোর্স বা ডিপ্লোমা ডিগ্রী নেই নার্স এর
★★মেয়াদ উত্তীর্ণ ছিল হাসাপাতালের লাইসেন্স
আজ বুধবার (২৪ আগষ্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যম কে এসব তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি জানান, গত ২১ আগস্ট, ২০২২ তারিখ সকালে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানাধীন তুমুলিয়া ইউনিয়নের আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী ভিকটিম শিরিন বেগম (৩২) এর প্রসব বেদনা উঠলে একই ইউনিয়নে বসবাসরত পূর্ব পরিচিত “জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনেস্টিক সেন্টার” এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বন্যা আক্তারের মাধ্যমে উক্ত হাসপাতালে সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য ভিকটিম ভর্তি হয়।
পরবর্তীতে ওটি বয় আশিকের তত্ত্বাবধানে রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা ও আল্টাসনোগ্রাম করে সিজারের জন্য রোগীকে ওটিতে নেয়া হয়। পরবর্তীতে ডাক্তার মাসুদ গাইনোকলজিস্ট না হয়েও রোগীর সিজার করেন। ওটি শেষে ব্লিডিং হওয়ায় ডাক্তার মাসুদ এর পরামর্শক্রমে আশিক এবং বন্যা রোগীর পরিবারকে এবি পজেটিভ রক্ত সংগ্রহের কথা বলেন।এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে ভিকটিমের ভাই ও ননদের ছেলের এবি পজেটিভ গ্রুপের রক্ত হওয়ায় তাদের নিকট হতে রক্ত সংগ্রহ করা হয়। প্রথমে ভিকটিমের ভাইয়ের শরীর থেকে এক ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে রোগীর শরীরে পুশ করা হয়। আরও এক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজনে ননদের ছেলের শরীর থেকে রক্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাকে হাসপাতালের বেডে শোয়ানো হয়। এরই মধ্যে হাসপাতালের কর্তব্যরত নার্সরা ভিকটিমের শরীরে বি পজেটিভ গ্রুপের রক্ত পুশ করে। ভিকটিমের শরীরে এবি পজেটিভ গ্রুপের রক্তের পরিবর্তে বি পজেটিভ গ্রুপের রক্ত পুশ করায় রোগীর খিচুনি উঠলে বিষেষজ্ঞ ডাক্তারের অনুপস্থিতে আশিকের তত্তবধানে রোগীর চিকিৎসা চলতে থাকে। একপর্যায়ে রোগীর শারীরিক অবস্থারঅবনতি হলে সন্ধ্যার দিকে আশিক ও বন্যা তরিগরি করে রোগীকে ঢাকায় প্রেরণের পরামর্শ দেয়।
পরবর্তীতে ভিকটিমের পরিবার রোগীকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলে পথিমধ্যে রোগীর অবস্থার আরও অবনতি হলে ঢাকার উত্তরার একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক রোগী অ্যাম্বুলেন্সে থাকাবস্থায় প্রাথমিক পরীক্ষায় রোগী মৃত বলে জানায়।
ভুল চিকিৎসার অভিযোগে প্রসুতির মৃত্যুর ঘটনাটি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টিহয় এবং ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনায় উপজেলা স্বাস্থ্য অফিসের নির্দেশনায় কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গাইনি ডাক্তার সানজিদা পারভীনকে আহ্বায়ক করে ০৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ফলশ্রুতিতে র্যাব হত্যাকান্ডে জড়িতদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৩ আগস্ট ২০২২ তারিখ রাতে র্যাব-১ এর একটি আভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানাধীন বালিগাঁও বড়নগর এলাকা হতে ১) বন্যা আক্তার (৩১), স্বামী- ওসমান গণি, থানা- কালীগঞ্জ, জেলা- গাজীপুর, ২) মোঃ আশিকুর রহমান (২৫), পিতা- মোঃ চাঁন মিয়া, থানা- দেলদুয়ার, জেলা- টাঙ্গাইল, ৩) সংগিতা তেরেজা কস্তা (৩৩), পিতা- অরুন কস্তা, থানা- কালীগঞ্জ, জেলা- গাজীপুর, ৪) মেরী গমেজ (৪০), স্বামী- ক্লেমেন্ট ক্রশ, থানা- কালীগঞ্জ, জেলা- গাজীপুর, ৫) সীমা আক্তার (৩৪), স্বামী-শরীফ মিয়া, থানা-মাস্টারবাড়ী রুপগঞ্জ,জেলা-নারায়ণগঞ্জ এবং ৬) শামীমা আক্তার (৩২), স্বামী-ইয়াসিন সুমন, থানা-কালীগঞ্জ,জেলা-গাজীপুরদেরকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় গ্রেফতার আসামীদের নিকট হতে ভিকটিমের চিকিৎসা সংক্রান্ত ও হাসপাতাল পরিচালনার মেয়াদ উত্তীর্ণ নথিপত্র উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা প্রসুতির মৃত্যুর সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে।
প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, উক্ত ‘‘জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার’’ এ নিয়মিত কোন ডাক্তার ছিলো না। মেয়াদোত্তীর্ণ কাগজে চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাচ্ছিল হাসপাতালটি।হাসপাতালটিতে গড়ে প্রতি মাসে ২৫ থেকে ৩০টি সিজারিয়ান অপারেশনসহ প্রায় ৫০টির অধিক বিভিন্ন অপারেশন সম্পন্ন করা হতো বলে গ্রেফতারকৃতরা জানায়। এক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগী প্রাপ্তি সাপেক্ষে অন কলে থাকা বিভিন্ন ডাক্তারদেরকে ডাকতেন। সিজারিয়ান অপারেশন এর ক্ষেত্রে একজন গাইনোকোলজিষ্টের ওটি চার্জ ছিলো তিন হাজার টাকা এবং এনেস্থলজিষ্টের দেড় হাজার টাকা সর্বমোট সাড়ে চার হাজার টাকা ডাক্তারদের প্রদান করতঃ বলে জানা যায়। পরিপ্রেক্ষিতে ক্লিনিক কর্তৃক রোগী ভেদে বিভিন্ন প্যাকেজে ১০-১৫ হাজার টাকা সংগ্রহ করত।হাসপাতালে কর্মরত সকল নার্স এবং স্টাফদের প্রতিমাসে গড় মোট বেতন ছিলো এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা। আর ডাক্তারদের রোগী প্রাপ্তি সাপেক্ষে ভিজিট দেওয়া হতো। এছাড়াও হাসপাতালটিতে অন্যান্য কিছু টেস্ট করা হতো যেমন-আল্ট্রাসনোগ্রাম, রক্তের (সিবিসি) টেস্ট ইত্যাদি।
গ্রেফতারকৃত অভিযুক্ত বন্যা আক্তার’কে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় সে ডিগ্রি পাস। সে উক্ত হাসপাতালের অন্যতম অংশীদার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার কোন নার্সিং ডিগ্রী নেই। তবে সে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ৭ বছর নার্সিং ও ২.৫ বছর ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছিল। পরবর্তীতে সে ২০১৮ সালে ০৮ জনের যৌথ মালিকানায় “জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়গনস্টিক সেন্টার” হাসপাতালটি চালু করে। বর্তমানে হাসপাতালটির মালিক তিনজন বলে জানা যায়।
গ্রেফতারকৃত অভিযুক্ত মোঃ আশিকুর রহমানএসএসসি পাস। সে ২০১৬ সালে টাংগাইল ম্যাটস থেকে ৩ বছরের ডিএমএফ (ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল ফ্যাকাল্টি) কোর্স পাস করে। পরিচয়ের সূত্রে হাসপাতালটির প্রতিষ্ঠাকাল হতে বিশ হাজার টাকা মাসিক বেতনে জনসেবা হাসপাতালে ওটি বয়, ডক্টর সহকারী হিসেবে কাজ করে আসছিল। ঘটনার দিন গ্রেফতারকৃত আশিক ডাঃ মাসুদের সহকারী হিসেবে ওটিতে উপস্থিত ছিল। ওটির পূর্বে সে রোগীর আল্ট্রাসনোগ্রাম করে। রোগীর ভর্তি ও ডিসচার্জ পেপারে নিজেই স্বাক্ষর করে। তবে সেখানের নার্স ও ভিকটিম পরিবার তাকে ডাক্তার হিসেবে জানত। রোগী তদারকি, ডাক্তারদের সাথে সার্বক্ষণিক সমন্বয় রাখা, বিভিন্ন ধরণের টেস্ট করা ও ডাক্তারদের পক্ষে কাগজপত্রে ভুয়া স্বাক্ষর করার সাথে জড়িত ছিল।
গ্রেফতারকৃত অভিযুক্ত সংগিতা তেরেজা কস্তাএসএসসি পাশ। উক্ত ডায়াগনেস্টিক সেন্টারের সে একজন সিনিয়র নার্স হিসেবে কর্মরত। সে ৩ বছর মেয়াদী জুনিয়র নার্সিং কোর্স পাশ করে পনের হাজার টাকা বেতনে উক্ত হাসপাতালে০৭ মাস ধরে চাকরি করে আসছিল।
গ্রেফতারকৃত অভিযুক্ত মেরী গমেজ এসএসসি পাশ। উক্ত হাসপাতালের সে একজন জুনিয়র নার্স হিসেবে কর্মরত। সে ২ বছর মেয়াদী জুনিয়র নার্সিং কোর্স পাস করে সাত হাজার টাকা বেতন উক্ত হাসপাতালে ২ বছর ধরে চাকুরী করে আসছিল।
গ্রেফতারকৃত অভিযুক্ত সীমা আক্তারএসএসসি পাশ। উক্ত ডায়াগনেস্টিক সেন্টারে সে নার্স হিসেবে কর্মরত ছিল। তার কোন নাসিং কোর্স বা ডিপ্লোমা ডিগ্রী নেই। সে ছয় টাকা বেতনে উক্ত সংস্থায় ০৪ বছর ধরে চাকরি করে আসছিল।
গ্রেফতারকৃত অভিযুক্ত শামীমা আক্তার এসএসসি পাশ। উক্ত হাসপাতালে সে একজন রিসিপশনার এবং রোগী দেখার সিরিয়ার হিসেবে কাজ করে। তার কোন নার্স কোর্স বা ডিপ্লোমা নাই। সে সাত হাজার পাঁচশত টাকা বেতনে উক্ত সংস্থায় ২ সপ্তাহ ধরে চাকরি করছে বলে জানায়।
“জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়গনস্টিক সেন্টার”এর কাগজপত্র বিশ্লেষনে জানা যায় হাসপাতাল ও ডায়গনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স এর মেয়াদ ৩০ জুন ২০২১ তারিখে শেষ হয়েছে। এছাড়া ট্রেড লাইসেন্স এর মেয়াদ ৩০ জুন ২০২২ তারিখে শেষ হয়েছে। আরোজানা যায় হাসপাতালটির ফায়ার লাইসেন্স ও শিল্প প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স মেয়াদ উত্তীর্ণ এছাড়া হাসাপাতালের কোন পরিবেশগত ছাড়পত্র পাওয়া যায় নি।
গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
রিপোর্ট- মোঃ জাহাঙ্গীর আলম পলক,
মন্তব্য